সংগ্রাম ও গৌরবের ৩৫ বছর

 

 

মহান স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান  দেশ ও জনগণের দুর্দিনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাহসিকতার সাথে বারবার এগিয়ে এসেছেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা কিংবা ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লবের ঘটনা বাংলাদেশের অস্তিত্বের সাথে জড়িত বলেই জিয়াউর রহমানকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা সম্ভব নয়। আর তাঁর হাতে গড়া দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে যে অবদান রেখেছে বিশ্বে এর জুড়ি মেলা ভার। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পাহারাদার হিসেবে তিনি এ রাজনৈতিক দলটি গঠন করেছিলেন। বাকশাল বাতিল করে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, স্বৈরাচার পতন, আধিপত্যবাদীদের হাত থেকে বাংলাদেশ রক্ষার দীর্ঘ সংগ্রামে দলটি ৩৫ বছর পেরিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠনের প্রেক্ষাপট বর্ণনায় স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের চিত্রও চলে আসে।

 

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী স্বাধীন দেশে গণমানুষ যে তৃপ্তির ঢেঁকুর গিলেছিল, নিমিষেই তা বিষাক্ত হয়ে ওঠে। রক্ষী বাহনীসহ লাল বাহিনী, নীল বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ মানুষের ওপর নতুন করে চেপে বসে ‘বাকশাল’ নামের স্বৈরাচার ও দুঃশাসনের খড়গ।

 

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের জাতীয় ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক আলোচিত অধ্যায়। এই দিন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সহ-সভাপতি ও বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর কিছু অফিসারের বল প্রয়োগমূলক ঘটনার মধ্য দিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। ১৬ আগস্ট খন্দকার মোশতাক আহমদ নিজেই রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ  নেন। সে সময়ে সেনাবাহিনীর প্রধান কেএম শফিউল্লাহ, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, রক্ষীবাহিনী, বিডিআর ও আনসারসহ সব বাহিনীর প্রধান নতুন এ সরকারের প্রতি আনুগত্য ও সমর্থন ব্যক্ত করেন।

 

 ১৬ আগস্ট বাসস ও রয়টার্সের এক খবরে লন্ডন প্রবাসী অনেক বাঙালি নতুন এ সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে বলে প্রচার করে। এছাড়াও বলা হয় মওলানা ভাসানীসহ অনেক রাজনীতিবিদ নতুন সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছেন।  আগস্ট বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মি. ডেভিস ই বোস্টার এবং সোভিয়েত চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স মি. জিকে গ্রুসেস্কি নতুন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের সমর্থন জানান।  (দৈনিক বাংলা, ২১ আগস্ট ১৯৭৫)

 

২৪ আগস্ট মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর-উত্তম পিএসসি সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান। অন্যদিকে জেনারেল এমএজি ওসমানীকে রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ২৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর জোয়ানদের উদ্দেশে এক ভাষণ দেন। তিনি অফিসার ও জোয়ানদের শৃংখলা ও দেশের জন্য আত্মোৎসর্গের নজির স্থাপনের আহ্বান জানান। জেনারেল জিয়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ‘জাতীয় সেনাবাহিনী’ উল্লেখ করে প্রশিক্ষণ, কঠোর পরিশ্রম ও কর্তব্যনিষ্ঠার দ্বারা অফিসারদের নিজ নিজ পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির আহবান জানান। চিফ অব স্টাফ নিষ্ঠা, ত্যাগ ও মমত্ববোধের মনোভাব দিয়ে অফিসারদের স্ব-স্ব দায়িত্ব পালনের পরামর্শ দেন।

 

ব্রিটিশ দৈনিক ‘দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ’ শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে ‘ফল অব এন আইডল’ নামে একটি বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধ প্রকাশ করে। তাতে উল্লেখ করা হয় ‘দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি প্রভৃতি গুরুতর সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতার জন্য তাকে জীবন দিতে হয়েছে। ‘সিঙ্গাপুরের প্রভাবশালী দৈনিক ‘দ্য স্ট্রেইট টাইমস’ ১০ সেপ্টেম্বর ৭৫ এক সম্পাদকীয় নিবন্ধ ছাপে। নিবন্ধে উল্লেখ করা হয় ‘অসহায়তা, অপুষ্টি, নানা রকম রোগব্যাধি, বেকারত্ব দুর্নীতি ও স্বাভাবিক মুদ্রাস্ফীতিতে তিনি  শেখ মুজিবুর) কেবল বক্তৃতা ও জনসভাই করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত একথাও বলেছেন, আমার হাতে আলাদিনের প্রদীপ নেই। যার ফলশ্রুতিতে পরিবর্তন হয়ে ওঠে অনিবার্য।’ এশিয়ার বিখ্যাত সাপ্তাহিক ‘দ্য ফার ইস্টার্ন ইকোনোমিক রিভিউ’ শেখ মুজিবের পতনকে তার আত্মঅহঙ্কার ও ব্যক্তি স্বাধীনতা বিরোধী মনোভাব, অতিমাত্রায় ব্যক্তি কেন্দ্রিক ক্ষমতায় বিশ্বাসের পরিণতি বলে মন্তব্য করে।

 

মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পাওয়ার পর সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে অধিকতর দেশপ্রেম জাগাতে সবসময় সচেষ্ট ছিলেন। পাশাপাশি ধর্মীয় মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিয়ে স্বাধীনতা ও সার্বাভৌমত্ব রক্ষায় আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে সেনা সদস্যদের বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেন। ১৯৭৫ সালের ২৪ অক্টোবর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ইঞ্জিনিয়ার্স মসজিদ উদ্বোধনকালে বলেন, ‘ধর্মীয় বিশ্বাস ছাড়া বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করা যায় না। আমাদের মতো ক্ষুদ্র দেশের সৈনিকরা যদি ধর্মীয় উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত হন, তাহলে যে কোন ধরনের প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।’

 

 

সিপাহী-জনতার বিপ্লব

 

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে আর একটি ঐতিহাসিক দিন। এ দিন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে জাতীয় ঐক্যের প্রতীকের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে সিপাহী জনতা ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবের মাধ্যমে এ দেশের রাজনীতির গতিপথ নতুন করে নির্মাণ করে। তৎকালীন সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য রাতের আঁধারে বিদ্রোহ করে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ নিজেকে সেনাপ্রধান হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ৩ নভেম্বর সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দি করেন। ওইদিন জাতীয় চারনেতাকেও জেলখানায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাককে পদচ্যুত করে ৬ নভেম্বর বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেয়া হয়।


জিয়াউর রহমান ৩ নভেম্বর বন্দি হবার পর ৭ নভেম্বর পর্যন্ত এই চার দিন দেশ ও দেশের জনগণ দুঃসহ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে অতিক্রম করে। ৬ নভেম্বর রাত প্রায় ১টার সময় সশস্ত্র বাহিনীর পুনরুত্থানবাদী চক্রের বিরুদ্ধে বীর জনগণ, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর সিপাহীরা বিপ্লব ঘটিয়ে ষড়যন্ত্রের নাগপাশ ছিন্ন করে বন্দি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেন। সিপাহী ও জনতার মিলিত বিপ্লবে গত চার দিনের দুঃস্বপ্নের ইতি ঘটে। আওয়াজ ওঠে ‘সিপাহী জনতা ভাই ভাই’, ‘জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ’। ৭ নভেম্বর সিপাহী বিপ্লবের ফলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিরাপদ হয়।

 

৭ নভেম্বর শুক্রবার সকালে জিয়াউর রহমান রেডিও বাংলাদেশ-এ এক ঘোষণায় বলেন, প্রিয় দেশবাসী আসসালামু আলাইকুম, আমি মেজর জেনারেল জিয়া বলছি, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জনগণ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ, আনসার এবং অন্যদের অনুরোধে আমাকে সাময়িকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের চীফ মার্শাল ‘ল’ এ্যাডমিনিস্ট্রেটর ও সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয়েছে। এই দায়িত্ব ইনশাআল্লাহ আমি সুষ্ঠুভাবে পালন করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। আপনারা সকলে শান্তিপূর্ণভাবে যথাস্থানে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করুন। দেশের সর্বত্র অফিস, আদালত, যানবাহন, বিমানবন্দর, মিল-কারখানাগুলি পূর্ণভাবে চালু থাকবে। আল্লাহ আমাদের সকলের সহায় হোন। খোদা হাফেজ। বাংলাদেশ- জিন্দাবাদ।

 

মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সিপাহী জনতার সফল বিপ্লব ও বেতারে জিয়ার কণ্ঠস্বর শুনে হাজার হাজার মানুষ নেমে এসেছিল রাজপথে। আনন্দে উদ্বেল মানুষের এক অভূতপূর্ব জোয়ার নেমেছিল ঢাকার পিচ ঢালা রাস্তায়। পরের দিন জাতীয় দৈনিকগুলোতেও লাল-কালো হেডলাইনে সিপাহী-জনতার বিপ্লব ও রাজধানীতে সাধারণ মানুষের উল্লাসের খবর প্রকাশিত হয়।


দৈনিক ইত্তেফাকে ‘প্রাণবন্যার উচ্ছল নগরী’ শিরোনামে সিপাহী-জনতার বিপ্লব সম্পর্কে প্রকাশিত ৫ নভেম্বরের রিপোর্ট : ‘তখনো আকাশে অন্ধকাল ছিল। গোলাগুলির শব্দে প্রকম্পিত শেষ রজনীর ঢাকা। শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্তগুলি ছিল যুগের মতো। বিনিদ্র রাত্রিতে আতঙ্কিত নগরবাসী হয়তো ভেবেছিল একাত্তরের সেই পাষাণ ঢাকা দিনগুলির কথা। এমনি সময়ে রেডিও বাংলাদেশের ঢাকা কেন্দ্রের ঘোষকের কণ্ঠে ধ্বনিত হলো শ্লোগান ‘সিপাহী বিপ্লব জিন্দাবাদ’। উৎকণ্ঠ নগরবাসীর শ্রবণেন্দ্রিয়। এই অসময়ে রেডিও কি বার্তা শোনাবে? ঘোষকের কণ্ঠে ঘোষিত হলো : ‘সিপাহী বিপ্লব সফল হয়েছে। প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের হাত থেকে জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করা হয়েছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিবেন।’


ঘোষকের এ ঘোষণার মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটল চার দিনের অস্বস্তিকর দুঃস্বপ্নের। ভোরের আলো উঠিবার আগেই জনতা নামিল রাস্তায়। প্রচন্ড গুলির মুখেও নিঃশঙ্ক দুঃসাহসী পদক্ষেপে। রাস্তায় সেনাবাহিনীর গাড়ি আর ট্যাংকের ঘর ঘর শব্দ। ইহার পর মিছিল, মিছিল আর মিছিল। সিপাহীদের প্রতি উৎফুল্ল অভিনন্দন বা হৃদয় নিংড়ানো আলিঙ্গন। সেনাবাহিনী পরিণত হইল জনগণের সেনাবাহিনীতে। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সকাল মুখরিত হইল জনতার জয়নিনাদে। সামরিক বাহিনীর গাড়িতেই নহে-বাস ট্রাকে সেই একই দৃশ্য। দেশের সার্বভৌমত্বকে অক্ষুন্ন রাখিবার জন্য আকুল আবেদন রাখিয়াছেন-কামনা করিয়াছেন জনগণের ঐকান্তিক সহযোগিতা। সিপাহীদের সঙ্গে জনতার আনন্দোচ্ছল প্রাণের স্পন্দন একই লয়ে স্পন্দিত হইয়াছে গতকাল।

 

মানুষের আনন্দের জোয়ার ও অস্থিরতা কমে আসলে ১০ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম দপ্তর বন্টন করেন। দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রেসিডেন্টের সচিবালয়, কেবিনেট সচিবালয়, পকিল্পনা, আইন, সংসদ ও বিচার বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন প্রেসিডেন্ট নিজে। তিনজন উপপ্রধান সামরিক আইন শাসনর্তা নিযুক্ত হন। তারা হলেন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর-উত্তম পিএসসি, নৌবাহিনী প্রধান কমোডর মোশাররফ হোসেন খান ও বিমান বাহিনী প্রধান এয়াভাইস মার্শাল এম জি তাওয়াব।

 

জিয়াউর রহমান শিল্প, বাণিজ্য, পাট, শিক্ষা, বিজ্ঞান, কারিগরি গবেষনা, আনবিক শক্তি, অর্থ, স্বরাষ্ট্র ও তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। এয়ার ভাইস মার্শাল এম জি তাওয়াব বিমান চলাচল ও পর্যটন, ডাক টেলিফোন ও টেলিগ্রাম, পেট্টোলিয়াম, গণপূর্ত, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়, খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।

 

কমোডর মোশাররফ হোসেন খান পান বন্দর, জাহাজ চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন, যোগাযোগ, বন্যা নিয়ন্ত্রন, পানি সম্পদ ও বিদ্যুৎ, শ্রম সমাজকল্যাণ, সংস্কৃতিবিষয়ক ও ক্রীড়া, ভূমি প্রশাসন ও ভুমি সংস্কার, বন, মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। (১১ নভেম্বর ১৯৭৫, দৈনিক বাংলা)

 

 

গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে সেনাপ্রধান জিয়ার  ভাষণ

 

১৯৭৫ সালের ২৩ নভেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান ভাষণ দেন। জেনারেল জিয়াউর রহমান অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সরকারের দৃঢ় সংকল্পের কথা পুনরায় উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আমাদের সরকার সম্পূর্ণ নির্দলীয় ও অরাজনৈতিক। সামরিক বাহিনী সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ উল্লেখ করে তিনি বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই সরকারের উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য সাধনে সরকার ও দেশের প্রশাসনকে দৃঢ় ও কার্যকর রাখতে সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমাদের দেশের জনগণ ভাল করে জানে-কারা দেশের শত্রু। আমাদের দেশের জনগণ জানে-কারা দেশের স্বার্থে এবং কারা স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করছে। জিয়া হিংসাত্মক ও নাশকতামুলক কাজে লিপ্ত ব্যক্তি এবং যে সব বহি:শক্তি আমাদের ধ্বংস করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তাদের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য জনসাধারনের প্রতি আহ্বান জানান।

 

১৯৭৬ সালের ৭ জনুয়ারি জিয়াউর রহমান রামপুরা টেলিভিশন কেন্দ্রে তথ্য ও বেতার দপ্তরের পদস্থ কর্মচারীদের এক সমাবেশে বলেন, জাতীয় ভাবাদর্শে অবিশ্বাসীদের দ্বারা দেশের মঙ্গল হতে পারে না। তিনি দেশের মানুষকে জাতীয় অগ্রগতি, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও গণশিক্ষা বিস্তার সম্পর্কে উদ্বুদ্ধ করার কাজে বেতার সংবাদপত্র ও অন্য গণমাধ্যগুলোর ভূমিকার উপর গুরত্বারোপ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের সব জনগণকে এক দৃষ্টিতে দেখার জন্য তিনি চেষ্টা করেছেন। শ্রেনী-বর্ণ নির্বিশেষে সবার সমস্যা সমাধানের প্রতি ছিল তাঁর নজর। ১৯৭৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি গারো সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, উপজাতিদের সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার সম্ভাব্য সব কিছু করবে। গারো এলাকার জনসাধারণের যোগাযোগ  ও অন্যান্য সমস্যা সম্পর্কে সরকার সজাগ রয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য স্থানীয় জনগণের সহযোগিতা চান তিনি।

 

৭ ফেব্রুয়ারি জিয়াউর রহমান ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান অ্যান্ড সার্জন এর উদ্যোগে আয়োজিত কন্টিনিউইং মেডিকেল এডুকেশন- এর উদ্বোধনীতে বলেন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্য শিক্ষায়াতনগুলোতে উপযুক্ত শিক্ষা লাভের অনুকুল পরিবেশ নিশ্চিত করতে সরকার সংকল্পবদ্ধ। শিক্ষাদানের জন্য শিক্ষায়াতন সমূহের যা কিছু প্রয়োজন, তা সবই দেয়া হবে। তিনি বলেন, ‘নানা কারণে গত দশ বছরে আমাদের শিক্ষায়াতনগুলোতে যেমন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে ভালভাবে লেখাপাড়া হয়নি। যার ফলে জ্ঞান ও বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে প্রায় একটি জেনারেশন গ্যাপের সৃষ্টি হয়েছে।

 

১৯৭৬ সালের ১৩ মার্চ রামপুরা টেলিভিশন ভবনে বেতার ও তথ্য বিভাগের পদস্থ অফিসারদের এক সমাবেশে জেনারেল জিয়া বলেন, ‘আমরা সকলে বাংলাদেশি, আমরা প্রথমে বাংলাদেশি এবং শেষেও বাংলাদেশি। এই মাটি আমাদের, এই মাটি থেকে আমাদের অনুপ্রেরণা আহরণ করতে হবে। জাতিকে শক্তিশালী করাই আমাদের লক্ষ্য। ঐক্য, শৃংখলা, দেশপ্রেম, নিষ্টা ও কঠোর মেহনতের মাধ্যমেই তা সম্ভব। শিল্পী, চিত্রকর, লেখক, কবি ও সাংবাদিকরা সৃজনশীল কর্মী এবং জনসাধারণ তাদের শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। তারা জনগণেকে অনুপেরণা দিতে পারে। টেলিভিশন আমাদের জীবনে ও সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনে সমর্থ।’ এই বক্তব্যের মধ্য দিয়েই জাতীয়তাবাদের দর্শন স্পষ্ট বোঝা যায়। ১৮ মার্চ ‘৭৬ অর্থনীতি সমিতির সমাপনী অধিবেশনে জেনারেল জিয়া বলেন, ‘সভ্যতার বাণী পল্লীর দরিদ্র ও নিরক্ষর জনগণের নিকট পৌঁছাতে হবে। বাংলাদেশ মানে একটি গ্রাম, বাংলাদেশকে উন্নত করতে হলে গ্রাম উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতিকে উন্নত করতে হবে।’

 

২৫ মার্চ ৭৬ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণে জিয়া বলেন, ‘জনগণের অপূর্ণ প্রত্যাশা পূরণে নতুন শপথ নিতে হবে। যে আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলনের জন্য আমরা স্বাধীনতার পথে পা বাড়িয়েছিলাম জনসাধারনের সেই প্রত্যাশা আজও পূর্ণ হয়নি। তা পূরণ করার জন্য আামদের নতুন করে শপথ নিতে হবে। আমরা কারও অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে চাই না। অন্য কেউ আমাদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করুক, তাও আমাদের অভিপ্রেত নয়। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব কিছুতেই ক্ষুন্ন হতে দেব না।’

 

১ এপ্রিল ৭৬ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান খুলনায় এক জনসভায় ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে দেশের সমস্যাগুলির সমাধানের উদ্দেশ্যে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ চিরদিন থাকবে এবং এ দেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি দেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে অটুট থাকবে।'

 

জাতিকে উন্নয়ন, অগ্রগতি ও জাতীয়তাবাদের প্লাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন জিয়াউর রহমান। ৬ এপ্রিল ৭৬ কমিল্লা স্টেডিয়ামে এক জনসভায় জিয়াউর রহমান বলেন, ‘পার্টিতে পার্টিতে, গ্রুপে গ্রুপে অতীতের সকল পার্থক্য ভুলে গিয়ে দেশের প্রগতির জন্য ‘বাংলাদেশি’ রূপে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যেতে হবে। বাংলাদেশ একটি সুবৃহৎ গ্রাম ছাড়া আর কিছুই নয়। গ্রামভিত্তিক স্বনির্ভর কর্মসূচি জনপ্রিয় করার জন্যে আমাদের অবশ্যই সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে।’

 

শুধু দেশে নয়, উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে সচেষ্ট ছিলেন জিয়াউর রহমান। ২৪ এপ্রিল ৭৬ সিলেট স্টেডিয়ামে জেনারেল জিয়াউর রহমান বলেন, উপমহাদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। উপমহাদেশে শান্তিপূর্ণ অবদান রাখতে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশ টিকে থাকার জন্য এসেছে এবং যেকোন মুল্যে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা হবে।

 

 

রাজনীতিতে প্রবেশের আগে জিয়াউর রহমানের ভাষণ

 

রাজনীতিতে ঢোকার আগে ১৯৭৬ সালের ১ মে জেনারেল জিয়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। জেনারেল জিয়া বলেন, বাংলাদেশ আজ সার্বভৌম ও স্বাধীন। এর প্রতি ইঞ্চি মাটি রক্ষায় বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ ও আনসার, সাবেক মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ প্রস্তুত। মে দিবস উপলক্ষে জিয়াউর রহমান শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে একই ভাষণ দেন। জিয়াউর রহমান বলেন, আমরা সবাই শ্রমিক। শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সরকার সর্বাত্মক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, মে দিবসের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার জন্য সরকার এ আশ্বাস দিচ্ছে যে, শ্রমিকদের স্বার্থ সর্বদাই অক্ষুন্ন রাখা হবে। জেনারেল জিয়া বলেন, শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য সরকার অব্যাহতভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এসবের মধ্যে তাদের স্বাস্থ্য রক্ষার ব্যবস্থা ট্রেড ইউনিয়ন ট্রেনিং, পেশাগত ও কারিগরি, মেধা ও যোগ্যতা বৃদ্ধি, চাকরির নিশ্চয়তা বিধান, পরিবার পরিকল্পনা ব্যবস্থা প্রভৃতি রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

 

 জেনারেল জিয়া আত্মনির্ভশীলতা অর্জনের প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘অলসতা দূর করে আমাদের অধিক পরিশ্রম করতে হবে। শতকরা ২০-২৫% উৎপাদন বৃদ্ধির শপথ নিতে হবে। তিনি বলেন, ব্রিটিশ বা পাকিস্তানি আমলে আমরা ৭ ঘন্টা কাজ করতে পারলে নিজেদের দেশ গড়ার জন্যে প্রয়োজনে আমারা ২০ ঘন্টা করে কাজ করতে প্রস্তুত।’

 

১৯৭৬ সালের ৬ মে চীনের রাষ্ট্রদূত চুয়াং ইয়েন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান ও উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় চুয়াং বলেন, বাংলাদেশের প্রতি চীনের সমর্থন অব্যাহত থাকবে। তখন জিয়া বলেন, সমতার ভিত্তিতে সবার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা হবে।

 

 

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জিয়াউর রহমান

 

মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালের ১১ মে ৪০ জাতি ইসলামী সম্মেলনে যোগ দিতে তুরস্ক যাত্রা করেন। এটাই ছিল জিয়াউর রহমানের প্রথম বিদেশ সফর। ১৩ মে মেজর জেনারেল জিয়া ইসলামী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে ভাষণ দেন। তিনি গঙ্গার পানি বন্টনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ইসলামী সম্মেলনে জিয়াউর রহমান বলেন, মাসওয়ারি ভিত্তিতে গোটা বছরের জন্য আন্তর্জাতিক নদীর পানির ন্যায়সঙ্গত বন্টনের মধ্যেই গঙ্গার পানি সমস্যার একমাত্র সমাধান নিহিত। দুটি দেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত একই নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার অধিকারী বাংলাদেশ এবং সেই কারণে যুক্তিসঙ্গতভাবেই পানির ন্যায্য অংশ চাই।   দৈনিক বাংলা, ২২ মে ৭৬)

 

ইস্তাম্বুলে ইসলামী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্মেলনে যোগদান শেষে সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ঢাকায় ফিরে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর সাথে আমাদের সহাযোগিতা ও ভ্রাতৃসম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠতর হয়েছে। সৌদি আরবের বাদশা খালেদ, তুর্কী প্রধানমন্ত্রী সোলায়মান ডেমেরেল, ইরানের প্রধানমন্ত্রী আমির আব্বাস হোবায়দা ও মুসলিম নেতাদের সাথে তার ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।

 

জিয়াউর রহমান দেশকে এগিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুসম্পর্ক তৈরির পাশাপাশি গ্রাম উন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছিলেন। এজন্য তিনি সব জনগণকে পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির অধীনে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। ১৯৭৬ সালের ১ জুন বঙ্গভবনে পল্লী উন্নয়ন পরিষদের এক বৈঠকে জিয়াউর রহমান বলেন, ‘সঠিক পথে প্রচেষ্টা চালাতে হবে, যাতে উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছে। বিশেষ করে যারা হতভাগ্য তাদের যেন কাছে পৌঁছে। পল্লী অর্থনীতির সামগ্রিক উন্নতি হলে গ্রাম থেকে শহরে যাত্রার মোড় সম্পূর্ণ ঘুরে যাবে এবং উল্টো হাওয়া বইবে।’ জিয়া বলেন, ‘পল্লী এলাকায় বিদ্যুতায়ন দ্রুততর করা সরকারের নীতি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন তৎপরতা বিশেষ করে কৃষি, পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্যরক্ষা সম্পর্কে পল্লী এলাকার মানুষদের শিক্ষা দিতে সরকার টেলিভিশন এবং বেতার প্রচার ব্যবস্থা সম্প্রসারণের নীতি গ্রহণ করেছে।’

 

 

মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন

 

মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় ভিত্তিতে সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে জিয়াউর রহমান একটি স্কিম প্রণয়ন করেন। ১২ জুন ৭৬ ঢাকায় বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় দপ্তর উদ্বোধন উপলক্ষে সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান এক বাণীতে বলেন, যে উৎসাহ-উদ্দীপনা দৃঢ়তা ও সজাগ দৃষ্টি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুর মোকাবেলা করেছিলেন, তার সদ্ব্যবহার করা হয়নি। পরের দিন বেইলি রোডে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নতুন কার্যালয় উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন এবং তাদের দেশগঠনের কাজে নিযুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা শৌর্য-বীর্য ও আত্মত্যাগের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা ইতিহাসে অতুলনীয়। তিনি বলেন, অতীতে নজিরবিহীন স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের খ্যাতিই বিনষ্ট করা হয়নি বরং জাতির মর্যাদা ক্ষুন্ন করা হয়েছে। তিনি বলেন, জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে যে দেশপ্রেম দিয়ে আপনারা অংশ নিয়েছিলেন, সেই দেশপ্রেম নিয়ে এবার অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে শামিল হবেন।

 

 

সরাসরি রাজনীতিতে জড়ানোর আগ্রহ প্রকাশ

 

১৯৭৬ সালের আগষ্টের প্রথম দিকে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দেশে রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সরাসরি বক্তব্য দেন। ৩ আগস্ট ৭৬ বঙ্গভবনে পদস্থ কর্মচারীদের সমাবেশে জিয়া বলেন, সরকার দেশে এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সংকল্পবদ্ধ, যে ব্যবস্থা জনগণকে তাদের অধিকার ও ক্ষমতা প্রয়োগের পূর্ণ সুযোগ প্রদান করবে। আমাদের জনগণ দীর্ঘকাল ধরে শোষণ ও দুর্দশার স্বীকার। সৌভাগ্যবশত এখন তারা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সুফল লাভে সমর্থ হয়েছে। কোন অবস্থাতেই তারা স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপস করে না। গোষ্ঠী ও ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য রাজনীতি ব্যবহার করা অনুচিত। জনগণের আশা-আকাঙ্খা বাস্তবে রূপান্তরিত করা প্রত্যেকের কর্তব্য।

 

 

ফারাক্কা সমস্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন জিয়া

 

১২ আগস্ট ৭৬ জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বিদেশী সাংবাদিকদের সাথে আলোচনায় জিয়াউর রহমান বলেন, ফারাক্কা ও সীমান্ত সংঘর্ষ বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা। কোন দেশেরই অন্য কোন দেশের উপর আধিপত্য বিস্তারে কিংবা অথনৈতিকভাবে দেশকে পঙ্গু করার চেষ্টা করা উচিত নয়। সব দেশেরই নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী নিজেদের ভাগ্যের রূপ দেয়ার সার্বভৌম অধিকার রয়েছে। এই অধিকার প্রয়োগের সুযোগ সবাইকে দিতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ দু’টি প্রধান সমস্যার মোকাবিলা করছে। তা হল ফারাক্কা ও সীমান্ত ইস্যু।

 

১৩ আগস্ট জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে জিয়াউর রহমান বড় বড় রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের কবল থেকে ক্ষুদ্র জাতিগুলোকে রক্ষার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ক্ষুদ্র জাতির অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বড় বড় দেশের হস্তক্ষেপেই বর্তমান বিশ্বে ক্ষুদ্র জাতির সর্ব প্রধান বিপদ। বৈদেশিক চাপ, বিদেশী আধিপত্য, নাশকতা, অন্তর্ঘাত ও অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশী হস্তক্ষেপের প্রতিরোধের জন্য সুস্পষ্ট ও কঠোর কার্যব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দ্বিপাক্ষীয় সম্পর্ক ব্যবস্থার ব্যাখ্যা করতে হবে। সব জাতীয় প্রশ্ন ও সমস্যা সমাধানে এখন বহুপাক্ষিক সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

 

জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন শেষে ১৯ আগস্ট ৭৬ দেশে ফিরে জিয়াউর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, অপরের মুরব্বিয়ানা সহ্য করা হবেনা।

 

২১ সেপ্টেম্বর ৭৬ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল অধিবেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জিয়া সীমান্তের ওপার হতে সম্প্রসারণবাদী দূরভিসন্ধি নিয়ে জাতীয় স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে পরিচালিত ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ প্রতিহত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আহবান জানান।

 

১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৬ জিয়াউর রহমান সাভারে আনসার বাহিনীর ৮ম ও ৯ম ব্যাটালিয়নের শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে অভিযোগ করেন, আমাদের সার্বভৌমত্বের উপর নির্লজ্জ হামলা চালানো হচ্ছে। দৃঢ়তার সাথে তিনি উচ্চারণ করেন, ইনশাআল্লাহ আমরা এই হামলা প্রতিহত করবো। প্রয়োজন হলে কষ্টার্জিত স্বাধীনতা  সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে শেষ রক্তবিন্দু দিতে দ্বিধা বোধ করব না।

 

 

উৎপাদন বাড়াতে খাল খনন কর্মসূচি

 

১ নভেম্বর ৭৬ যশোরে উলশী-যদুনাথপুর খাল খনন প্রকল্প উদ্বোধনকালে জেনারেল জিয়া বলেন, হিন্দুস্তান বা পাকিস্তান যেভাবে স্বাধীনতা পেয়েছে আমাদের স্বাধীনতা সেভাবে আসেনি। একটা মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি। আমরা দুঃখজনকভাবে বহু বছর ধরে বিদেশীদের দ্বারা আমাদের সম্পদ লুণ্ঠনের শিকার হয়েছিলাম। শোষণের কবল থেকে মুক্তির জন্য আমাদের লড়তে হয়েছিল। তাই আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব অনেক বেশি মূল্যবান। এ স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে ফলপ্রসূ করতে তিনি হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান।

 

৩০ নভেম্বর ৭৬ জিয়াউর রহমান ঘোষণা করেন, বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই অথনৈতিক ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ সাফল্যের প্রশংসা করছে। তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট সকলের নিষ্ঠা ও কঠোর পরিশ্রমের জন্যই এটা সম্ভব হয়েছিল। দেশের সম্মুখে আজ প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে ইতিমধ্যে অর্জিত অগ্রগতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। প্রতিটি সংস্থায় প্রতিটি ক্ষেত্রে যাতে ঐক্য, সহযোগিতা ও কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ অটুট তাকে তার জন্য তিনি সিনিয়র কর্মকর্তাদের প্রতি নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, এ জন্য সিনিয়র কর্মকর্তাদের প্রায়ই পল্লী এলাকা সফরে যাওয়া এবং হিসেব নেয়া চালু করতে উপযুক্ত দেখাশুনা সুনিশ্চিত করা উচিত। তিনি বলেন, চলতি বছরের জন্য ১১শ’ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কার্যক্রম অবশ্যই পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে। এতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হবে এবং কর্মসংস্থান বাড়বে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন অব্যাহত রাখার জন্য শান্ত ও স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। শান্তি ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে এবং সরকারি ও বেসরকারি খাতে উন্নয়ন প্রচেষ্টার জন্য উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে সরকার ইতিমধ্যে কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

 

রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য বিশেষ করে নতুন ও অপ্রচলিত আইটেমের রপ্তানি বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আমদানি রপ্তানি ক্ষেত্রে দেশের লক্ষ্য হওয়া উচিত সুষম। তিনি বলেন, জনগণ যাতে তাদের নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারে সেজন্য অবশ্যই তাদের সাহায্য করতে হবে। পল্লী উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য খাল খনন, পল্লী বিদ্যুতায়ন ও কুটির শিল্প স্থাপনকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। জেনারেল জিয়া বলেন, দেশেকে মন্থরতা পুষিয়ে নিতে হবে। নিজেদের ও ভবিষ্যৎ বংশধরদের প্রতি আমাদের কর্তব্য রয়েছে। জনগণের শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির নয়া যুগের সূচনার জন্য আমাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে না পারলে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাই উৎপাদন কিভাবে বাড়ানো যায়, সেজন্য চেষ্টা চালাতে হবে। সেচ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো খাল খনন করা। খাল খনন ও পানি চলাচল ব্যবস্থা নিশ্চিত হলে আমাদের জমির উৎপাদন শক্তি বাড়বে। ফলন বাড়বে।

 

 

সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান

 

১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম জাতীয় স্বার্থে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান পিএসসির কাছে হস্তান্তর করতে এক ঘোষণা জারি করেন।

 

ওই ঘোষণায় বলা হয়, যেহেতু আমি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ১৯৭৫ সালের ৮ নভেম্বর ঘোষণা বলে প্রধান আইন প্রশাসকের ক্ষমতাসমূহ গ্রহণ করেছিলাম এবং সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী প্রধানদের উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করেছিলাম এবং যেহেতু আমি এখন উপলব্ধি করছি যে, জাতীয় স্বার্থেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের ক্ষমতাসমূহ সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর-উত্তম পিএসসির-ই প্রয়োগ করা উচিত, তাই এই ব্যাপারে আমাকে প্রদত্ত সকল ক্ষমতা এবং ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট ও ৮ নভেম্বর ঘোষণার বিধানসমূহের সংশোধন অনুসারে আমি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট এখন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ও দায়িত্বভার মেজর জেনারল জিয়াউর রহমান বীর-উত্তম পিএসসিকে হস্তান্তর করছি।’ (১ ডিসেম্বর ১৯৭৬ দৈনিক বাংলা)

 

১৯৭৬ সালের ৪ ডিসেম্বর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। তিনি এতে সুখী সমৃদ্ধশালী সমাজ গড়ে তুলতে সামগ্রিক জাতীয় প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগের জন্য জনগণের প্রতি উদাত্ত আহবান জানান। তিনি বলেন, আমাদের স্বপ্ন ও প্রচেষ্টা হবে স্বাস্থ্যে, সঙ্গীতে, উচ্চ মননশীলতায় একটি সমৃদ্ধ জাতি গড়ে তোলা। দেশের আজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হচ্ছে নিঃস্বার্থভাবে জনগণের সেবায় উদ্বুদ্ধ সৎ কর্মী ও নেতৃত্ব। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বাংলাদেশের ৬২ হাজার গ্রামের সাথে সাত কোটি মানুষের জন্য গ্রামমুখী অর্থনীতি গড়ে তোলার ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন। দেশের অর্থনীতিতে বর্তমান যে গতি এসেছে, উন্নয়নের যে মানসিকতা সৃষ্টি হয়েছে, দেশে বিদেশে বিশেষজ্ঞরা তার প্রশংসা করছেন। কৃষিকে বাংলাদেশের প্রাণ বলে তিনি অভিহিত করেন। তিনি বলেন, দেশের বাড়তি জনশক্তিকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে গ্রামীণ পরিকল্পনার মাধ্যমে পতিত জমি আবাদ করতে হবে। সবজি চাষের ক্ষেত বাড়াতে হবে বহুগুণ। গো-সম্পদের পরিচর্যা নিতে হবে। হাজামজা পুকুরের সংস্কার করে মাছের চাষ বাড়াতে হবে। সেচব্যবস্থা সম্প্রসারিত করতে হবে। সার বন্টন ও কৃষি ঋণ প্রদানে সুষ্ঠু ব্যবস্থা নিতে হবে। সমাজের সবার একতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, যে মহৎ স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম সে লক্ষে পৌঁছাতে হলে আমাদের কতগুলো আদর্শ সামনে রেখে এগুতে হবে। তিনি মনে করেন, সে আদর্শ হওয়া উচিত আল্লাহর ওপর অসীম ভরসা, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। স্বাবলম্বন ও সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণভিত্তিক প্রশাসন সাজাতে হবে।  (দৈনিক বাংলা, ৫ ডিসেম্বর ১৯৭৬)

 

 

আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জিয়ার সাহসী কণ্ঠ

 

১৯৭৭ সালের দিকে সীমান্তে ভারতের পক্ষ থেকে নানামুখী নেতিবাচক কার্যক্রম শুরু হয়। এসময় প্রতিটি জনসভায় জিয়াউর রহমান আধিপত্যবাদী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে জনগণকে পরামর্শ দেন। ১৯৭৭ সালের ১ মার্চ জেনারেল জিয়া শেরে বাংলা নগরে গ্রাম প্রতিরক্ষা দলের সপ্তাহব্যাপী সমাবেশের সমাপনী অনুষ্ঠানে বলেন, সীমান্তে দুষ্কৃতিকারীদের হামলা প্রতিহত করার জন্য সর্বাত্মক তৎপরতা বজায় রাখতে হবে। এবং প্রতিরোধকে আরো সুসংহত করতে হবে। তিনি বলেন, বেশ কিছুকাল ধরে কোন কোন সীমান্ত এলাকায় অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সীমান্তের অপর পারে আশ্রিত লালিত কিছু সংখ্যক দুষ্কৃতিকারী সীমান্তবর্তী এলাকায় লোকালয় ও ফসলাদির উপর হামলা চালাবার অবিরাম প্রয়াস পাচ্ছে। মাঝে মাঝে নিরীহ গ্রামবাসীর জানমালের ক্ষতি করছে।

 

স্বাধীনতার পর কয়েক বছর পর্যন্ত জনজীবনের অশান্তি, বিশৃঙ্খলা, খুন, রাহাজানি, চোরাচালান, মজুদদারি, মুনাফাখোরি, প্রভৃতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, জাতির সৌভাগ্য যে, জনসাধারণ এবং আপনাদের ন্যায় দেশপ্রেমিক কর্মীদের সহায়তায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য সংস্থা ও জনসাধারণের মিলিত শক্তির সামনে সীমান্ত ও অভ্যন্তরে পরিচালিত সকল অশুভ তৎপরতা নস্যাৎ হয়ে যাবে। গ্রাম প্রতিরক্ষা দলের ন্যায় আমরা সকলে যদি দরদ দিয়ে দেশবাসীকে সুখী করে তোলার মহৎ লক্ষ্য সামনে রেখে একতা ও জাতীয়তাবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অবিরাম কাজ করে যাই, তবে সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।  (দৈনিক বাংলা, ২মার্চ ১৯৭৭)

 

 

আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি অগাধ বিশ্বাস

 

জেনারেল জিয়াউর রহমান রাসুল (সঃ) এর আদর্শকে অনুসরণীয় হিসেবে মনে করতেন। হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর শিক্ষা ও জীবনাদর্শ অনুসরণ করে বিশ্বে নিজেদের একটি আদর্শ জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার শপথ গ্রহণের আহ্বান জানান জেনারেল জিয়া। সচিবালয় মসজিদে এক মিলাদ মাহফিলে তিনি বলেন, আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার লক্ষ্য হবে, দেশের সকল নাগরিকের জন্য খাদ্য,  বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করা। দেশ থেকে সকল অবিচার দূর করে মানব সেবার মাধ্যমে একটি আদর্শ সমাজের ভিত্তি নির্মানের জন্য আমাদের শপথ নেয়া। রাসুলুল্লাহর অনুসৃত সমাজ ব্যবস্থা বাংলাদেশের মতো একটি নব্য স্বাধীন দেশের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তিনি বলেন, আল্লাহর কাছে আমরা প্রার্থনা করি, আমরা যাতে বিশ্বাস, ঐক্য, শৃঙ্খলা ও নিষ্ঠার সাথে দেশের সকলের শান্তির জন্য কর্তব্য কাজে নিয়োজিত হতে পারি। (৩ মার্চ ১৯৭৭, দৈনিক বাংলা)

 

ইরানের বহুল প্রচারিত ফারসি ভাষার দৈনিক এতেলাত-এ এক নিবন্ধে বলা হয়, ‘চল্লিশ বছর বয়স্ক জেনারেল এক বছর তিন মাস ধরে দায়িত্বে রয়েছে। এই সময় বাংলাদেশের অবস্থা পাল্টে গেছে। দারিদ্র্য ও আশ্রয়হীনতার অসুরটাকে জিয়াউর রহমান থামিয়ে দিয়েছে। এ নিবন্ধটি রচনা করেন হংকস্থ সংবাদদাতা সাফাহেরী’ (৭ মার্চ ১৯৭৭ দৈনিক বাংলা)

 

 

আন্তর্জাতিক নেতা জিয়াউর রহমান

 

১৯৭৭ সালের ৮ মার্চ জিয়াউর রহমান ইরানের শাহেনশাহের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন। শাহেনশাহর সাথে জিয়া বিশ্ব পরিস্থিতি, আঞ্চলিক সমস্যা ও দ্বীপক্ষীয় বিষয়ে আলোচনা করেন। জিয়াউর রহমান বলেন, দেশের সামনে যেসব সমস্যা রয়েছে, সেভাবে সেগুলো মোকাবেলা হচ্ছে। জিয়াউর রহমান শান্তি ও সম্প্রীতিতে বসবাস এবং জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের অর্থনীতি গড়ে তুলতে বাংলাদেশের অব্যাহত প্রয়াসের বিষয়ে শাহেনশাহের সাথে আলোচনা করেন।

 

৯ মার্চ ভারতকে ইঙ্গিত করে বলেন দুষ্কৃতকারী পাঠানো বন্ধ কর। আমাদের গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা দাও। তাতে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো দূর হবে। আমাদের সীমান্তের ওপারে দুষ্কৃতকারীদের ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। সয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য সহায়তা দিয়ে তাদেরকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করা হচ্ছে। দুস্কৃতকারীরা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পন করছে।  (দৈনিক বাংলা, ১০ মার্চ ১৯৭৭) 

 

১৪ মার্চ ১৯৭৭ জিয়াউর রহমান গণচীন সফরকালে তাঁর সম্মানে দেং শিয়াও পিং আয়োজিত একটি নৈশভোজে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ যেকোন মূল্যে তার জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুসংহত করতে বাংলাদেশের জনগণের লৌহদৃঢ় সংকল্প সমগ্র বিশ্ব উপলব্দি করেছে। তিনি বলেন, স্বাধীনতা রক্ষার চেয়ে বড় ত্যাগ আর কিছু নেই। বাংলাদেশের জনগন গঙ্গার পানির উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করে দুষ্কৃতকারীদের সীমান্তে হটিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর।  (দৈনিক বাংলা, ১৫ মার্চ ১৯৭৭)

 

 

স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া

 

১৯৭৭ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে দৈনিক বাংলা পত্রিকায় ‘আমি মেজর জিয়া বলছি’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে বলা হয়, ‘আমি মেজর জিয়া বলছি। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর অস্থায়ী প্রধান সেনাপতি হিসেবে আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।’ ৭১-এর ২৭ মার্চ বাংলাদেশের ইতিহাসের এক স্বর্নোজ্জল দিন। প্রতিরোধের প্রত্যয় জ্বলে উঠা আগুন ঝরা একটি দিন। সাড়ে সাত কোটি মানুষের জীবনে তখন নেমে এসেছিল ভয়াবহ বিভীষিকা। দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর হামলায় তারা তখন পর্যুদস্ত দিশেহারা, গোলাগুলির কান ফাটানো আওয়াজ, ট্যাঙ্কের ত্রাস জাগানো গর্জন, মহল্লায় মহল্লায় আগুনের লেলিহান তান্ডব, সব ছাপিয়ে আর্তমানবতার হৃদয়বিদারী চিৎকার, নিরাপত্তার সন্ধানে মানুষ তখন ছুটছিল, হাজার হাজার লাখে লাখে নারী-পুরুষ-শিশু ঘরবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল। ছুটছিলো গ্রামের দিকে। ছুটছিলো অজানা ভবিষ্যতের দিকে, ঠিক এমনি মুহূর্তে এই ঘোষণায় চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ভেসে এল মেজর জিয়ার দৃপ্ত কন্ঠ, ডাক এল স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার। আকস্মিক হামলায় পর্যুদস্ত মানুষের জন্য এ ডাক যেন ছিল ধ্রুবতারার মতো উজ্জল এক পথের নিশানা। মার খাওয়া জাতি মুহুর্তেই থমকে দাঁড়ালো, তারপর গর্জে উঠল প্রতিরোধের দৃঢ় প্রত্যয়ে। ঝাঁপিয়ে পড়ল স্বাধীনতার সংগ্রামে। এই ঘোষণা সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল মানুষ যেমন পেল পথের সন্ধান, তেমনি থরথর করে কেঁপে উঠল দখলদার বাহিনী। একবার দুবার তিনবার চট্টগ্রামের স্বাধীনবাংলা বেতারে বার বার প্রচারিত হল মেজর জিয়ার ঘোষণা। পরে আরেক ঘোষণায় তিনি বলেন, আমরা এর মধ্যেই একটি সার্বভৌম আইনানুগ সরকার গঠন করেছি। এই সরকারকে বৈধ গনতান্ত্রিক সরকারের স্বীকৃতি দানের জন্য তিনি বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক দেশের প্রতি আহ্বান জানান। সারাদেশে তখন জ্বলছে প্রতিরোধের আগুন। এ প্রতিরোধের সূচনা ২৫ মার্চ রাতে। এ প্রতিরোধের দুঃসাহসিক নায়ক মেজর জিয়া। শুরু হল সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম। এই সংগ্রামেরই চূড়ান্ত পরিণতি স্বাধীনতা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা’।

 

৩১ মার্চ ১৯৭৭ বাংলাদেশ রাইফেলস-এর স্বাধীনতা উত্তর প্রথম পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে জিয়া বলেন, কোন শত্রু সে যতই শক্তিশালী হোক না কেন, আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে যাতে বিন্দুমাত্র আচড় না পড়ে, সেজন্য সাধ্যমত আমাদের আত্মদান আমরা বৃথা যেতে দেব না। সারা জাতি শহীদদের প্রতি চির কৃতজ্ঞ। সেনাবাহিনীর প্রধান বলেন, অর্পিত দায়িত্ব যাতে সক্ষমভাবে পালন করতে পারে সে জন্য বিডিআরকে একটি শ্রেষ্ঠ বৃহত্তর বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছে। অস্ত্রশস্ত্র যন্ত্রপাতি ও যোগযোগ ব্যবস্থার দিক থেকে এ বাহিনীকে আধুনিক করে গড়ে তোলা হয়েছে। (১ এপ্রিল ‘৭৭, দৈনিক বাংলা)

 

 

প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ

 

২১ এপ্রিল ১৯৭৭ প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সায়েম ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে দায়িত্ব ত্যাগ করে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনিত করেন। সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান বঙ্গভবনে অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন।

 

২২ এপ্রিল জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট হিসেবে জাতির উদ্দেশ্যে প্রথম বেতার ও টেলিভিশনে ভাষণ দেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া বলেন, এ বছর ৩ মে প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে দেশব্যাপী গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটধিকারের ভিত্তিতে ৭৮ সালের ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জনগণের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটিয়ে সংবিধাণের প্রয়োজনীয় সংশোধণী জারি করা হচ্ছে। পার্যায়ক্রমে খোলা রাজনীতির পথ প্রশস্ত করা হবে। গণতন্ত্রে পূর্ণ বিশ্বাস এবং জনগণের নির্বাচিত সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংকল্প তিনি ঘোষণা করেন। পৌরসভা সমূহ ও জেলা পরিষদের নির্বাচন এ বছর যথাক্রমে আগস্ট ও ডিসেম্বরের অনুষ্ঠিত হবে। যে কোনমূল্যে জাতীয় সার্বভৌমত্ব স্বাধীনতা রক্ষায় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

 

২ মে এক ঘোষণায় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ৩ মে ৭৭ গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য একটি সামরিক আইন জারি করেন। এই গণভোট হবে তার উপর ও তার নীতির উপর এবং তার কর্মসূচির প্রতি ভোটারদের আস্থা আছে কি না সেজন্য। সে প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনের তত্বাবধানে এ গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। ভোটাররা কোন প্রশ্নে তাদের মতামত দেবেন এবং ব্যালটে ভোটদানের পদ্ধতি কি হবে তাও এতে সুস্পষ্টভাবে বলে দেয় হয়।

 

 

বাংলাদেশের ম্যাগনাকার্টা ১৯ দফা

 

২২ মে জিয়াউর রহমান আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে বাংলাদেশের ম্যাগনাকার্টা বা মুক্তির সনদ ঘোষণা করে। যা উনিশ দফা নামে খ্যাত। প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল জিয়া ঘোষিত ১৯ দফা কর্মসূচি হলো-

১.            সর্বতোভাবে দেশের স্বাধীনতা, অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা।

২.            শাসনতন্ত্রের চারটি মূলনীতি অর্থাৎ সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি সর্বাত্মক বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং

              সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায় বিচারের সমাজতন্ত্র জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রতিফলিত করা।

৩.           সর্ব উপায়ে নিজেদেরকে একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে গড়ে তোলা।

৪.            প্রশাসনের সর্বস্তরে উন্নয়ন কার্যক্রমে এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

৫.            সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীন তথা জাতীয় অর্তনীতিকে জোরদার করা।

৬.           দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা।

৭.            দেশে কাপড়ের উৎপাদন বাড়িয়ে সকলের জন্য অন্তত মোটা কাপড় সরবরাহ নিশ্চিত করা।

৮.           কোন নাগিরক যেন গৃহহীন না থাকে তার যথাসম্ভব ব্যবস্থা করা।

৯.            দেশকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করা।

১০.         সকল দেশবাসীর জন্য নূন্যতম চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা।

১১.         সমাজে নারীর যথাযোগ্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা এবং যুবসমাজকে সুসংহত করে জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ করা।

১২.          দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারী খাতে প্রয়োজনীয় উৎসাহ দান।

১৩.        শ্রমিকদের অবস্থার উন্নয়ন সাধন এবং উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে সুস্থ শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক গড়ে তোলা।

১৪.         সরকারী চাকরিজীবীদের মধ্যে জনসেবা ও দেশগঠনের মনোবৃত্তি উৎসাহিত করা এবং তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করা।

১৫.         জনসংখ্যা বিষ্ফোরণ রোধ করা।

১৬.        সকল বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে সমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা এবং মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক বিশেষ জোরদার করা।

১৭.          প্রশাসন এবং উন্নয়ন ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করা।

১৮.        দুর্নীতিমুক্ত ন্যায়নীতি ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা।

১৯.         ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অধিকার পূর্ণ সংরক্ষণ করা এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করা।  

                                                                                                                                                  (দৈনিক বাংলা ২৩ মে ১৯৭৭)

 

 

গণভোটে জিয়ার প্রতি জনগণের আস্থা

 

৩০ মে ৭৭ অনুষ্ঠিত গণভোটে জেনারেল জিয়া এবং তার ১৯ দফা কর্মসূচি ও নীতির প্রতি দেশবাসী বিপুল আস্থা জ্ঞাপন করে। ১২ হাজার ২৬৪ কেন্দ্রের ভোটের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোট ভোটের সংখ্যা ১ কোটি ৯২ লাখ ৯ হাজার ৬০। এর মধ্যে ১ কোটি ৮৯ লাখ ৯৩ হাজার ৯২ হ্যাঁ সূচক ভোটের সংখ্যা। না-সূচক ভোটের ২ লাখ ১৫ হাজার ৯৬৮। সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ তাদের আস্থার রায় জানিয়েছেন, স্বাধীনতাযুদ্ধের বীর সৈনিক এবং নবীন প্রত্যাশায় উদ্দীপ্ত বাংলাদেশের স্বর্ণালী অভিজ্ঞতার নায়ক জেনারেল জিয়াকে, জনগণ তাদের রায় দিয়েছেন স্বাধীনভাবে।

 

 

স্বল্পোন্নত দেশের প্রতিনিধি জিয়া

 

প্রেসিডেন্ট জিয়া ল্যাংকাস্টার হাউসে কমনওয়েলথ সরকার প্রধানদের চলতি সম্মেলনে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জনগণের দুঃখ দুর্দশা লাঘবের জন্য ৫ দফা ফর্মূলা প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলোকে তাদের জিডিপির শতকরা শূন্য দশমিক ৭ ভাগ পরিমাণ জাতিসংঘের দেয়া সরকারী উন্নয়ন সাহায্যের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করতে হবে। দায় দেনা পরিশোধ শুধু প্রকৃত সম্পদ হস্তান্তরের শর্ত সাপেক্ষে হতে হবে। বিদেশী সাহায্য হতে হবে শর্তহীন এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর চলতি ঋণের দায় সমূহের পুনর্বিন্যাস করতে হবে। একবারে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) জন্যে সমস্ত বকেয়া খরচ বাতিল করতে হবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ট্যারিফ সংক্রান্ত ও ট্যারিফ ভিন্ন অন্যান্য বাধা নিরসনের মাধ্যমে উন্নত দেশগুলোর বাজারে আরও বেশি প্রবেশাধিকার দিতে হবে।

 

উন্নয়নশীল দেশগুলো যখন খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখছে সেক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর উচিত সুবিধাজনক সহজ শর্তে আরও খাদ্য ও কৃষি সরঞ্জাম নিয়ে আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসা। কারণ এতে করে উন্নয়নশীল দেশেগুলোর সীমিত সম্পদের উপর চাপ কম পড়বে। বাংলাদেশের মতো কম উন্নত দেশগুলো যে বিরাট সমস্যার সম্মুখীন নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি ছাড়া তার সমস্যা সামাধান সম্ভব নয়। (দৈনিক বাংলা, ৯ জুন ৭৭)

 

১৯৭৭ সালের ১০ জুন ল-নে সরকারী প্রেস সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বলেন, কমনওয়েলথ ভুক্ত সমৃদ্ধ দেশগুলো স্বাল্পোন্নত দেশসূহের জন্য অনেক কিছু করতে পারে এবং ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যকার ব্যবধান কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে কমনওয়েলথ একটি সক্রিয় সংস্থা। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমস্যার সার সংকলন করে বলেন, প্রকৃত পক্ষে এই মুহুর্তে আমাদের প্রয়োজন হচ্ছে উন্নয়নের জন্য কাজ করার মতো উপযোগী করে সমগ্র জাতিকে একটি বিরাট শক্তিতে পরিণত করা। (১১ জুন ৭৭ দৈনিক বাংলা)

 

লন্ডনে কমনওয়েলথ সরকার প্রধানদের সম্মেলনে জিয়া আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের সংগ্রামী জনসাধারণকে বর্ণবাদী সংখ্যালঘু সরকারের কাছ থেকে সংখ্যাগরিষ্টদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করার জন্যে একটি সুনির্দিষ্ট ও বাস্তব জরুরি কার্যক্রম গ্রহনের আহ্বান জানান।

 

 

বার্মার সাথে সম্পর্কোন্নয়ন

 

১৯৭৭ সালের ২১ জুলাই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ৪ দিনের সফরে বার্মা যান। যাত্রাকালে বিমানবন্দরে তিনি বলেন, বার্মা আমাদের অতি নিকটবর্তী প্রতিবেশী এবং বার্মার সাথে আমাদের অত্যন্ত ভাল সম্পর্ক রয়েছে বার্মার সাথে আমাদের বানিজ্যিক সম্পর্ক পূর্ব থেকেই অব্যাহত রয়েছে।

 

চারদিনের সফরে বাণিজ্য সংস্কৃতি, সীমান্ত এবং সমুদ্রসীমাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তারা আলোচনা করেন। বিশেষ করে দুদেশের মধ্যে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছেন। (২১ জুলাই ১৯৭৭, দৈনিক ইত্তেফাক)

 

 

মুসলিম দেশের সাথে সস্পর্কোন্নয়ন

 

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ২৬ জুলাই তিন দিনের সফরে সৌদি আরব যান। বাদশাহ খালেদের সাথে বৈঠকে জিয়া বলেন, দুই দেশের বাণিজ্য বৃদ্ধির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখন্ডতার নিরাপত্তা বিধানের সাথে সাথে দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থের উন্নয়নই পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত। সমতা সার্বভৌমত্ব এবং অপরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ সকল রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব কামনা করে। প্রেসিডেন্ট জিয়া অভিমত প্রকাশ করেন যে, জাতীয় স্বার্থ উন্নয়নে পররাষ্ট্র দফতরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। (৩ আগস্ট ৭৭ দৈনিক ইত্তেফাক)

 

১৯৭৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মিসরীয় প্রেসিডেন্টের এক ভোজসভায় যোগ দেন। সেখানে তিনি অধিকৃত আরব ভূখন্ড থেকে ইসরাইল সৈন্য সম্পূর্ণ প্রত্যাহার এবং ফিলিস্তিনি জনগণের নিজস্ব আবাসভূমি প্রতিষ্ঠাসহ তাদের সকল অধিকারের স্বীকৃতি প্রদানই মধ্যপ্রাচ্যে সুষ্ঠু ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ বলে উল্লেখ করেন।  (দৈনিক ইত্তেফাক ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭)

 

 

সেনা ও বিমান সদস্যদের বিদ্রোহ দমন

 

১৯৭৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে কিছু সেনা সদস্য পেশাগত শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে। এই বিশৃঙ্খলার জের যাতে অন্য ক্যান্টনমেন্টগুলোতে এবং সাধারণ জনগণের মাঝে না পড়ে সেজন্য জিয়াউর রহমানের সরকার কঠোর পদক্ষেপ নেন। এরপর ২ অক্টোবর ঢাকায় বিমান সেনাদের এক রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থান দমনের পর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জাতির উদ্দেশ্যে এক বেতার ভাষণে বলেন, গত দুই বছর যাবত আমি ও আমার সরকার অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশের উন্নতির জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। দেশ ও জাতি বিশ্বের মানচিত্রে আজ স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত পৃথিবীর বিভিন্নরাষ্ট্র দিয়েছে অকুণ্ঠ সহযোগিতা এবং সম্মান।

 

দেশের এই ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ মূহুর্তে আমি অতি দুঃখের সাথে আপনাদের জানাচ্ছি যে, কিছু সংখ্যক বিপথগামী সৈন্য বেশ কিছুদিন যাবৎ স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনায় সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ভঙ্গ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর এইরূপ কিছু সংখ্যক সেনাবাহিনীর বিপথগামী লোক বিনা কারণে বগুড়ায় গোলযোগ সৃষ্টি করায় কিছু জানমালের ক্ষতি হয়। আল্লাহর রহমতে আপনাদের দোয়ায় সেনাবাহিনীর দেশ প্রেমিক সদস্যরা এই পরিস্থিতিতে তাদের আয়ত্বে আনতে সক্ষম হয়। উল্লেখ্য যে, বিমান সেনাদের অভ্যুত্থানে বেশক’জন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা নিহত হন এবং বিমান বাহিনী অপরিমেয় ক্ষতির মুখে পড়ে।   (দৈনিক ইত্তেফাক, ৩ অক্টোবর ১৯৭৭)

 

ক্যান্টনমেন্টে সেনা সদস্যদের বিশৃঙ্খলা দমনের পর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দেশের রাজনীতিক, মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের সাথে পৃথক আলোচনা ও মতবিনিময় করেন। ১৯৭৭ সালের ১১ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক দলের অর্ধশতাধিক নেতার সাথে বঙ্গভবনে বৈঠক করেন। তাদের সাথে আলোচনায় তিনি বলেন, দেশর সমুদয় ভবিষ্যৎ রাজনীতি হতে হবে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক। দেশে কোন গোপন রাজনীতি চলবে না। বিদেশী নির্দেশে যারা কাজ করে তাদের দেশ ছাড়াতে হবে। আবার দাসত্ব-শৃঙ্খলে আবদ্ধ হওয়ার জন্য আমরা ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করিনি।

 

কতিপয় লোক গণতন্ত্রের কথা বলেন কিন্তু যখনই আামরা তা চালু করতে চাই, তখনই তারা রক্তপাতের কথা বলেন, হিংসাত্মক কার্যকলাপের কথা বলেন, আমারাও ধীরে ধীরে প্রকাশ্য রাজনীতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এমনতর হুমকি থাকলে কিভাবে সেদিকে অগ্রসর হতে পারি।

 

১২ অক্টোবর বিভিন্ন জেলার ৬১ মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডারের সাথে তিনি মতবিনিময় করেন। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখার জন্য নিরলস কাজ করে যাওয়া এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে নিজ নিজ এলাকায় জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার পরামর্শ দেন তিনি। উৎপাদন বাড়াতে নানামুখি পদক্ষেপ সংবলিত কৃষিনীতি নির্ধারণী পরিষদের বৈঠকে জিয়া বলেন, আমরা যদি ৭০ লাখ একর জমিতে তিনটি ফসল, এক কোটি একর জমিতে দুটি ফসল এবং নিচু এলাকার ৫০ লাখ একর জমিতে একটি ফসল ফলাতে পারি তা হলে খাদ্য উৎপাদন যথেষ্ট বাড়ানো সম্ভব। উলশী-যদুনাথপুর ধরনের পানি সংরক্ষণ প্রকল্পের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন অনুরূপ বাড়ানো সম্ভব।

 

তিনি বলেন, দেশের চারশত যায়গায় উলশী-যদুনাথপুর ধরনের প্রকল্প গড়ে তোলা সম্ভব এবং এর মাধ্যমে অতিরিক্ত ৮০ লাখ টন খাদ্যশস্য ৎপাদন করা যেতে পারে। আমারা যদি পানি সংরক্ষণ প্রকল্পগুলি বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে শুধু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হব না, একটি খাদ্য রফতানিকারক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারব। (১৭ অক্টোবর ৭৭ দৈনিক ইত্তেফাক)

 

খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের এসব দিক নির্দেশনা জাতিকে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

 

 

ভারত সফর

 

১৯৭৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর জিয়াউর রহমান ফারাক্কা চুক্তি স্বাক্ষরকালে সমঝোতা ও সহযোগিতা মনোভাব অক্ষুন্ন রাখতে ভারতের প্রতি আহবান জানান। ভারতে দুদিনব্যাপী রাষ্ট্রীয় সফর উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সম্মানে ভারতীয় প্রেসিডেন্ট আয়োজিত ভোজসভায় তিনি এ আহ্বান জানান। এছাড়া এই সফরে ২০ ডিসেম্বর এক যুক্ত ইশতেহার ঘোষণা করা হয়। ঘোষনায় বাংলাদেশ-ভারত সমতা সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা এবং একে অপরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার ভিত্তিতে উভয় দেশের মধ্যে সস্পর্ক উন্নয়ন ও জোরদার করতে দৃঢ় সংকল্পের কথা উল্লেখ করেন। (দৈনিক আজাদ, ২০ ও ২১ ডিসেম্বর ১৯৭৭)

 

 

প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদের ওপর গুরুত্বারোপ

 

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধান ও মজুদ নিরূপন করতে একটি মাস্টার প্লান তৈরি করেছিলেন। দেশে গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে গ্যাস লাইনের সংযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়ে ছিলেন তিনি। যথাযথ অনুসন্ধানের মাধ্যমে গ্যাসের খনি আবিস্কার, গ্যাস উত্তোলন এবং সরবরাহ করতে তিনি একাধিক উদ্যোগ নেন। বিশেষ করে শিল্পকারখানায় প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহের বিষয়টি তিনি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেছিলেন। ১৯৭৮ সালের ১ জানুয়ারি সিলেটে তিতাস গ্যাস সরবরাহের উদ্বোধনকালে জিয়াউর রহমান বলেন, দেশে আবিষ্কৃত ৯টি গ্যাস খনিতে এ পর্যন্ত প্রায় ৯ লাখ কোটি ঘনফুট গ্যাস মজুদ রয়েছে। এর সুষ্ঠু ব্যবহারের পাশাপাশি নতুন নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিস্কারের চেষ্টা করছে সরকার । প্রকৃতিক গ্যাসকে যাথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে তেল ও কয়লার উপর অর্থ ব্যয় কমিয়ে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে হবে।  (দৈনিক বাংলা, ২ জনু, ১৯৭৮)

 

 

তোষামোদী বিমুখ জিয়া

 

প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে গিয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশার কথা শুনতেন। তাদের কাছ থেকেই সমাধানের পরামর্শ নিতেন। সরকার বা প্রেসিডেন্টের প্রশংসায় যারা ব্যস্ত থাকতেন, জিয়াউর রহমান তাদের পছন্দ করতেন না। এমনকি দেশে বিভিন্ন স্থানে মতবিনিময় কিংবা জনসভায় বক্তারা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে নিয়ে নানা রকম প্রশংসামূলক অভিধা দিয়ে তোষামোদ শুরু করলে তিনি তাদের বন্ধ করে দিতেন। তোষামোদী নেতা কর্মীদের কাছ থেকে মাইক কেড়ে নেয়ার মত উদাহরণও রেখে গেছেন জাতীয়তাবাদী রাজনীতির এই প্রাণপুরুষ। ১৯৭৮ সালের ৮ জানুয়ারি তিনি সন্দ্বীপ থানায় ডাক বাংলোতে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। সেখানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জিয়াউর রহমানকে নানা অভিদায় ভূষিত করে শুভেচ্ছা বক্তব্য দিতে থাকলে তিনি দাঁড়িয়ে বক্তব্য থামিয়ে দেন। জিয়া বলেন, ‘অলংকরণ ও অভিধা দিয়ে জনগণের পেট ভরবে না। তাই জনগণের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে হবে।’ (১২ জুন ১৯৭৮, দৈনিক বাংলা)

 

 

কমনওয়েলথ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট জিয়া

 

বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সামনে এগিয়ে নিতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্ব নেতৃত্বকে বারবার তাগাদা দিতেন। ১৯৭৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কনওয়েলথ সম্মেলনের মূল অধিবেশনে তিনি বলেন, ‘বৃহত্তর সক্রিয় সহযোগিতার মাধ্যমে নতুন ও ন্যায় সংগত এক বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এজন্য একক ও যৌথ নির্ভরতা অর্জনে উন্নয়শীল দেশগুলোর ক্ষমতা বাড়াতে হবে’। এলক্ষ্যে তিনি আঞ্চলিক দেশগুলোকে ৬ দফা উদ্যোগ গ্রহণের প্রস্তাব দেন। (১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৮, দৈনিক বাংলা)

 

 

জাতীয়তাবাদী দল (জাগদল) গঠন

 

১৯৭৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জাতীয়তাবাদী গণতন্ত্রী দল (জাগদল) সরকারি অনুমোদন পায়। রাজনৈতিক দলবিবিধ (পিপিআর) ১৯৭৮ মোতাবেক এ নয়া দলের অনুমোদনের কথা ঢাকা পৌরসভা চেয়ারম্যান আবুল হাসনাতকে চিঠির মাধ্যমে ২২ ফেব্রুয়ারি জানানো হয়।

 

বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে আহ্বায়ক করে জাগদলের ১৯ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ২২ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করা হয়। আহ্বায়ক কমিটির সদস্যরা ছিলেন- প্রফেসর সৈয়দ আলী আহাসান, আব্দুল মোমেন খান, শামসুল আলম চৌধুরী, ক্যাপ্টেন অব. নুরুল হক, এনায়েত উল্লাহ খান, মওদুদ আহমদ, জাকারিয়া চৌধুরী, ড. এম আর খান, সাইফুর রহমান, জামাল উদ্দিন আহমদ, আবুল হাসনাত, এম এ হক, ক্যাপ্টেন (অব.) সুজাত আলী, আলহাজ্ব এম এ সরকার ও আবুল কাশেম। (৩১ মার্চ ১৯৭৮, দৈনিক বাংলা)

 

 

জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দলে যোগদান

 

১৯৭৮ সালের ৯ এপ্রিল সালে জিয়াউর রহমান প্রথম আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন যে তিনি রাজনৈতিক দলে যোগদান করবেন এবং ডিসেম্বরের নির্বাচনে প্রার্থী হবেন।

 

২ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে চেয়ারম্যান করে ৬টি দলের সমন্বয়ে ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’ গঠন করা হয়। যে সকল রাজনৈতিক দল ফ্রন্ট গঠন করে, সেগুলো হলো- জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী), ইউনাইটেড পিপলস পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশ তফশিলি জাতীয় ফেডারেশন। জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের ৬টি অঙ্গ দলের এক বৈঠকে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে জিয়াউর রহমানকে মনোনয়ন দেয়া হয়। (৩ মে ১৯৭৮ দৈনিক ইত্তেফাক)

 

৮ মে সালে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক ছাত্রদলের ৩৬ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয় আহমেদ মির্জা খবিরকে। ১৯৭৮ সালের ২৯ মে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক মৎস্যজীবী দলকে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে অনুমোদন করা হয়।

 

১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন

 

দেশে গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বচনী অনুচ্ছেদ নং ১১৮ হতে ১২৬ অনুযায়ী ১৯৭৮ সালের ৩ জুন প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যক্ষ  সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সম্পন্ন করেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৭৮ সালে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচন অতীব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষ্য বহন করছে। এতে বহুদলীয় রাজনীতির ভিত্তিতেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রায় সকল রাজনৈতিক দলই এ নির্বাচনে অংশ নেয়। রাষ্ট্রপতি পদের জন্য মোট ১০ জন প্রার্থী পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তার মধ্যে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী), ইউনাইটেড পিপলস পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, লেবার পার্টি, তফসীল ফেডারেশন- এ ছয়টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন মেজর জেনারল জিয়াউর রহমান। অন্যদিকে তাঁর অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটের মনোনীত প্রার্থী জেনারেল (অব.) এম এ জি ওসমানী। আওয়ামী লীগ, জাতীয় জনতা পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি মোজাফফর), পিপলস পার্টি, গণআজাদী লীগ ও নিষিদ্ধ কমিউনিষ্ট পার্টির নেতাদের সমন্বয়ে গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট গঠিত হয়েছিল। অন্যদের মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং নির্দলীয় প্রার্থী ছিলেন।

 

নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট প্রার্থী জিয়াউর রহমান ১ কোটিরও বেশি ভোটের ব্যবধানে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ঐক্যজোট প্রার্থী জেনারেল (অব.) ওসমানীকে পরাজিত করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে মোট ৫৩ দশমিক ৫৪ ভাগ ভোটার ভোট দেন। এর মধ্যে ৭৩ দশমিক ৬৩ ভাগ ভোট পান জেনারেল জিয়াউর রহমান। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী এম এ জি ওসমানী পান ২১ দশমিক ৭০ ভাগ ভোট। (৫ জুন ১৯৭৮, দৈনিক ইত্তেফাক)

 

১৯৭৮ সালের ৫ জুন বিজয় উত্তর সাংবাদিক সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বলেন, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে আরো সুসংহত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই আমাদের লক্ষ্য। তিনি বলেন, এখন দলমত নির্বিশেষে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে এবং জাতি গঠনে উদ্যোগী হতে হবে। আমাদের সকলের লক্ষ্য হতে হবে দেশ ও জাতিকে শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করা (৬ জুন ১৯৭৮, দৈনিক ইত্তেফাক)

 

১৯৭৮ সালের ১২ জুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে জিয়াউর রহমান বঙ্গভবনের দরবার হলে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। (১৩ জুন ১৯৭৮, দৈনিক ইত্তেফাক) 

 

১৯৭৮ সালের ২৯ জুন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান উপদেষ্টা পরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে ২৮ সদস্যের একটি মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন। বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেন। মন্ত্রী পরিষদের সিনিয়র মন্ত্রী হিসেব শপথ নেন মশিউর রহমান যাদু মিয়া। মন্ত্রী পরিষদের অন্য সদ্যস্যরা হলেন,- ড. মির্জা নুরুল হুদা, শাহ আজিজুর রহমান, কাজী আনোয়ারুল হক, অধ্যাপক মোহাম্মদ শামসুল হক, আজিজুল হক, এসএম শফিউল আজম, আবদুল মোমেন খান, মেজর জেনারেল (অব. মাজিদুল হক, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল হালিম চৌধুরী, বি এম আক্কাস, লে. কর্নেল (অব.) আবু সালেহ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান, রসরাজ মন্ডল, মোহাম্মদ সাইফুর রহমান, জামাল উদ্দিন আহমেদ, ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কাজী জাফর আহমদ, শামসুল হুদা চৌধুরী, ক্যাপ্টেন (অব.) নুরুল হক, এ জেড এম এনায়েতউল্লাহ খান, মওদুদ আহমদ, এস এ বারী এটি, ড. মিসেস আমিনা রহমান, মির্জা গোলাম হাফিজ, কে এম ওবায়দুর রহমান, আবদুল আলীম, হাবিবুল্লাহ খান ও আবদুর রহমান। প্রতিমন্ত্রী হন দু’জন ডা. অসিউদ্দীন মাহাতাব ও ডা. এম এ মতিন।

 

এই মন্ত্রী পরিষদেও প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারণা বাস্তবায়ন করেন। মন্ত্রী পরিষদে ২৮ জন মন্ত্রীর মধ্যে ১৮ জন ছিলেন জাগদলের, ৪ জন ন্যাপ ভাসানীর, ২ জন ইউপিপির, ১ জন তপশিলী ফেডারেশনের। বিশেষত ৪ জন ছিলেন সাবেক সামরিক অফিসার, ৮ জন বেসামরিক অফিসার, ১ জন সাংবাদিক ও বাকীরা হলেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।

 

৯ আগস্ট প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯ দফা বাস্তবায়নে সারাদেশে ১৮টি কমিটি গঠন করেন। প্রত্যেকটির কমিটি প্রধান হিসেবে একজন মন্ত্রীকে দায়িত্ব দেয়া হয়।

 

 

বাংলাদশে জাতীয়তাবদী দল (বিএনপি) গঠন

 

জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের শরীক দলগুলির সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’ নামে একটি নতুন রাজননৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। এ পরিস্থিতিতে ২৮ আগস্ট বিচারপতি সাত্তার এক জরুরি আদেশে জাগদল ও এর সকল অঙ্গদলকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নামে একটি নতুন দল ঘোষণা করেন। ঢাকার রমনা গ্রীনে সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি এ ঘোষণা দেন।

 

সংবাদ সম্মেলনে জিয়াউর রহমান ঘোষিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ঘোষণাপত্রে বলা হয়- বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ইস্পাত কঠিন গণঐক্য, জনগণ ভিত্তিক গণতন্ত্র ও রাজনীতি প্রতিষ্ঠা, ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত জনগণের অক্লান্ত প্রয়াসের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনৈতিক মুক্তি, আত্মনির্ভরশীলতা ও প্রগতি অর্জন এবং সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ ও আধিপত্যবাদের বিভীষিকা থেকে মুক্তির লক্ষ্যকে নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’ গঠিত হয়েছে। এই চারটি লক্ষ্যকে ‘জনগণের মৌলিক দাবি’ বলে জনগণের ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়।

 

দলের কাঠামো ও গঠনতন্ত্রের বর্ণনায় তিনি জানান, ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, থানা, শহর/পৌরসভা, জেলা, নগর ওয়ার্ড, নগর থানা, নগর পর্যায়ের দলের কাউন্সিল ও নির্বাহী কমিটি গঠিত হবে। দলের সর্বোচ্চ স্তর হচ্ছে জাতীয় কাউন্সিল ও জাতীয় নির্বাহী কমিটি। এছাড়া থাকবে ১১ জন সদস্যের জাতীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি, পার্লামেন্টারি বোর্ড ও দলীয় নির্বাচনী কলেজ। জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে একজন সভাপতি, পাঁচজন সহ-সভাপতি, একজন সেক্রেটারি জেনারল, একজন কোষাধ্যক্ষ, চারজন সাংগঠনিক সম্পাদক এবং একজন করে প্রচার, সমাজকল্যাণ, ক্রীড়া, সংস্কৃতি, দফতর, যুব বিষয়ক, মহিলা বিষয়ক, ছাত্র বিষয়ক, শ্রম ও কৃষি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক থাকবেন। এছাড়া বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদক থাকবেন।

 

দলের ঘোষণাপত্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও জাতীয় গণতান্ত্রিক  ফ্রন্ট গঠনের মাধ্যমে সূচিত জাতীয় একতা ও সংহতির প্রক্রিয়াকে স্থায়ী ও সংঘবদ্ধ করা সময়ের দ্বিধাহীন দাবি ও জাতীয় জীবনের যুগসন্ধিক্ষণে জাগ্রত জনতার দাবিতে এ দল গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে জাতীর মিলন ও ঐক্যের দল বলে ঘোষণা করে এতে বলা হয় যে, এই দলের বৈপ্লবিক উদারতা ও বিশালতা সকল দেশপ্রেমিক মানুষকে এক অটল ঐক্যবাদী কাতারে শামিল করতে সক্ষম হবে। সক্ষম হবে জাতীয় পর্যায়ে স্থিতিশীলতা, সার্বিক উন্নতি ও প্রগতি আনয়ন করতে।

 

ঘোষণাপত্রে স্থিতিশীল গনতন্ত্রের রুপরেখায় প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার নির্বাচিত ও সার্বভৌম পার্লামেন্টের প্রতি দলের আস্থা জ্ঞাপন করা হয়। এতে দেশের শতকরা ৯০ জন অধিবাসী মধ্যবিত্ত গ্রামের সার্বিক উন্নয়নের প্রতি সকল পর্যায়ে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে ভূমি ব্যবস্থা ও প্রশাসনকে ন্যায় বিচার ভিত্তিক, আধুনিক ও সুবিন্যস্ত করার অঙ্গিকার করা হয়। গণমুখী কৃষি নীতি ও কার্যক্রম  প্রণয়ন, সমবায়ের ভিত্তিতে জাতীয় উন্নয়ন, সৃজনশীল উৎপাদনমুখী ও গণতান্ত্রিক শ্রমনীতি প্রণয়ন, গণমুখী জীবননির্ভর কার্যক্রম প্রণয়ন, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করতে দেশরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার, মুক্তিযোদ্ধাদের সৃজনশীল, গঠনমূলক ও উৎপাদানমূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, বাংলাভাষা, সাহিত্যের সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও প্রসার, শাসনতন্ত্রের জীবননির্ভর ও বাস্তবমুখী রুপ সংরক্ষণ ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি নিশ্চিতকরণে, সামাজিক ও বৈষম্য দুরিকরণ, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার সুদৃঢ় অঙ্গীকার করা হয় ঘোষণাপত্রে। (২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৮, দৈনিক বাংলা) 

 

১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে আহ্বায়ক করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ৭৬ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। কমিটিতে যারা ছিলেন:

আহ্বায়ক :  মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান

সদস্য: ১. বিচারপতি আবদুস সাত্তার, ২. মশিউর জাদু মিয়া, ৩. মোহাম্মদ উল্লাহ ৪. শাহ আজিজুর রহমান ৫. ক্যাপ্টেন (অব.) হালীম চৌধুরী, ৬. রসরাজ মন্ডল ৭. আবদুল মোমেন খান ৮. জামাল উদ্দিন ৯. ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ১০. মির্জা গোলাম হাফিজ ১১. ক্যাপ্টেন (অব.) নুরুল হক ১২. মোহাম্মদ সাইফুর রহমান ১৩. কে এম ওবায়দুর রহমান ১৪. মওদুদ আহমেদ ১৫. শামসুর হুদা চৌধুরী ১৬. এ জেড এম এনায়েতউল্লাহ খান ১৭. এস এ বারী এটি ১৮. ড. আমিনা রহমান ১৯. আবদুর রহমান ২০ ডা. এম এ মতিন ২১. আবদুল হালিম ২২. ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত ২৩. আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ২৪. নুর মোহামদ খান ২৫ আবদুল করিম ২৬. শামসুল বারী, ২৭  মজিবুর রহমান ২৮. ডা. ফরিদুর হুদা ২৯. শেখ আলী আশরাফ ৩০. আবদুর রহমান বিশ্বাস ৩১. ব্যারিস্টার আবদুল হক ৩২. ইমরান আলী সরকার ৩৩. দেওয়ান সিরাজুর হক ৩৪. এমদাদুর রহমান ৩৫. অ্যাডভোকেট আফসার উদ্দীন ৩৬. কবির চৌধুরী ৩৭. ডা. এম আর খান, ৩৮. ক্যাপ্টেন (অব.) সুজাত আলী ৩৯. তুষার কান্তি বাড়ৈ ৪০. সুনীল গুপ্ত ৪১. রেজাউল বারী ডিনা ৪২. আনিসুর রহমান ৪৩. আবুল কাসেম ৪৪. মনসুর আলী সরকার ৪৫. আবদুল হামিদ চৌধুরী ৪৬. মনসুর আলী ৪৭. শামসূল হক ৪৮. খন্দকার আবদুল হামিদ ৪৯. জুলমাত আলী খান ৫০. অ্যাডভোকেট নাজমুল হুদা ৫১. মাহবুব আহামেদ ৫২. আবু সাঈদ খান ৫৩. মোহাম্মদ ইসমাইল ৫৪. সিরাজুল হক মন্টু ৫৫. শাহ বদরুল হক ৫৬. আবদুর রউফ ৫৭. মোরাদুজ্জামান ৫৮. জহির উদ্দিন খান ৫৯.  সুলতান আহমেদ চৌধুরী  ৬০. শামসুল হুদা ৬১. সালেহ আহমেদ চৌধুরী ৬২. আফসার আহমেদ চৌধুরী ৬৩. তরিকুল ইসলাম ৬৪. আনোয়ারুল হক চৌধুরী ৬৫. মইন উদ্দিন খান  ৬৬. এম এ সাত্তার ৬৭ হাজী জালাল ৬৮ আহমেদ আলী মন্ডল ৬৯. শাহেদ আলী ৭০. আবদুল ওয়াদুদ ৭১. শাহ আবদুল হালিম  ৭২. ব্যারিস্টার জমির উদ্দীন সরকার ৭৩. আতা উদ্দীন খান ৭৪. আবদুর রাজ্জাক চৌধুরী ও ৭৫. আহমেদ আলী। (২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৮, দৈনিক বাংলা) 

১৯৭৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম ইল সুং প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব ‘রাষ্ট্র নিশান’ প্রদান করেন। 

 

১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচন ও বিএনপির সরকার গঠন

 

 প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সর্বোতভাবেই চেষ্টা করেছিলেন দেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সরকার প্রতিষ্ঠার। ১৯৭৮ সালের ৩০ নভেম্বর এক ঘোষণায় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনষ্ঠানের জন্য ১৯৭৯ সালের ২৭ জানুয়ারি তারিখের কথা উল্লেখ করেন। এ নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নেয় এবং তাদের বিভিন্ন দাবি ও শর্ত পূরণের জন্য নির্বাচন দুদফায় পেছানো হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২০৭ টি আসন পেয়ে সংখ্যাগাষ্ঠিতা লাভ করে। ৩৯ টি আসন পেয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (মালেক) প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা পায়। এছাড়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (মিজান) ২টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ৮টি, ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ পার্টি  (মোজাফফর) ১টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ও ইসলামী ডেমোক্রেটিক দল ২০টি, গণফ্রন্ট ২টি, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ২টি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলন ১টি, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল  (তোয়াহা) ১টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১৬টি আসন পায়।

 

 

বিএনপি সরকারের পথচলা

 

জনগনের ভোটে নির্বাচিত একটি সরকারের যে দায়িত্ব, জিয়াউর রহমান সেভাবেই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে নানামুখি পদক্ষেপ নেন। বিশেষ করে উন্নয়ন কার্যক্রমে জনগণকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেন তিনি। দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি তাঁর নির্দেশনা ছিল জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও চিন্তাদর্শনকে প্রাধান্য দিয়ে প্রতিটি এলাকায় দল ও সরকারের দর্শনের আহ্বান পৌঁছিয়ে দিতে হবে। ১৯৭৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বলেন, পার্টির সিদ্ধান্তই হবে সরকারি কর্মসূচির দিকদর্শন। বিএনপির প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হচ্ছে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনা।    (১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৮, দৈনিক ইত্তেফাক)

 

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনকালে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার নিরলস প্রচেষ্টার প্রশংসা করে বিশ্বের বিভিন্ন পত্রিকা। ইউনাইটেড প্রেস ইন্টরন্যাশনালের সুজান গ্রিন ঢাকা হতে প্রেরিত এক ডেসপাসে লিখেছেন, সাম্যের প্রতিক ও সৎলোক রূপে ব্যাপকভাবে গন্য জিয়াউর রহমান স্বনির্ভর সংস্কার কর্মসূচি শুরু করে বাংলাদেশের ভিক্ষার ঝুড়ি ভাঙ্গার প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। 

 

মালয়েশিয় দৈনিক ‘বিজনেরস টাইমস’-এ প্রকাশিত এই মহিলার ডেসপাসে বলা হয়েছে যে, ‘অতীতে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে পরিচিত করেছিল যে মহাপ্লাবী সমস্যাগুলো প্রেসিডেন্ট কার্যত এগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।’ (৪ নভেম্বর, ১৯৭৮, দৈনিক ইত্তেফাক)

 

বাকশালীদের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা ও ধ্বংসাত্মক তৎপরতা প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সাথে সহযোগিতা করার জন্য অন্য সকল রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানান। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির এক বিশেষ সভায় জিয়া বলেন, চিহ্নিত বাকশালীদের আসল উদ্দেশ্য জনগণ অনুধাবন করতে পেরেছে। এরা মিছিলের নামে সম্পদের ক্ষতি সাধন করছে। অগণতান্ত্রিক ও উচ্ছৃঙ্খল কার্যকলাপ করেই যাচ্ছে। এ মুহূর্তে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে আমাদের সাথে আসতে হবে। কারণ বাকশালীরা দেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে চায়।  (৯ জানুয়ারি, ১৯৮০, দৈনিক বাংলা)

 

১৯৮০ সালের ৫  ফেব্রুয়ারি বিএনপির রিসার্চ কাউন্সিল সেমিনারে জিয়া বলেন, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে কারো কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকার অবকাশ নেই। ৭৭ এর গণভোট ৭৮ এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, ৭৯ সালের পর্লামেন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ গ্রহণ করেছে। ৭৬ সালে শাসনতন্ত্র সংশোধনের পর সবকটি নির্বাচনেই জনগণের সামনে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদদের রাজনীতি উপস্থাপন করা হয়েছে। (৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮০, দৈনিক বাংলা)

 

১৯৮০ সালের ৪ আগস্ট বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান বলেন, যুবকরাই হচ্ছে আমাদের জাতীয় চিন্তা-চেতনা, স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্বের অগ্রদূত। তিনি বলেন, যুবদলই হচ্ছে বিএনিপর আশা ভরসা। আমরা চাই আমাদের যুব অঙ্গদল কেবল শহর কেন্দ্রিক না হয়ে গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে যাক। তিনি ৬৮ হাজার গ্রামে যুবদলের শাখা গড়ে তোলার জন্য আহ্বান জানান। (৫ আগস্ট, ১৯৮০, দৈনিক বাংলা)

 

এই সময় নিউইয়র্ক টাইমেসের এক সংখ্যায় বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং স্বনির্ভরতা অর্জন এবং উৎপাদন দ্বিগুণ করার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অক্লান্ত প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করা হয়। কাজের জন্য জনগণকে সংগঠিত ও  অনুপ্রাণিত করতে প্রেসিডেন্ট জিয়া প্রায়ই গ্রামে-গঞ্জে সফর করেন পত্রিকায় তা বিশেষভাবে উল্লেখ কর হয়। জনগণের সাথে সংযোগ রক্ষায় বাংলাদেশী নেতা শিরোনামে মাইকেল টি ক্যাফম্যানের এক রিপোর্টে গ্রাম-অঞ্চলে সপ্তাহে তিন-চারবার সফরের সময় প্রেসিডেন্টের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডের বিবরণ দেয়া হয়।

 

১৯৮০ সালের ১৬ নভেম্বর মরহুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে জিয়াউর রহমান বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং এর সার্বভৌমত্ব রক্ষায় মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর অসামান্য অবদান জাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। উপ-মহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের এ উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক সুদীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে দেশপ্রেম ও দেশ সেবার যে শাশ্বত দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা বিশ্বে বিরল।  (১৭ নভেম্বর ১৯৮০, দৈনিক বাংলা)

 

 

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাৎ

 

১৯৮১ সালের ২৯ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দুদিনের সফরে চট্টগ্রাম যান। ৩০ মে ভোরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সামরিক বাহিনীর কিছু সংখ্যক বিপথগামী অফিসার প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যা করেন। পরের দিন দৈনিক বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, ‘সরকার গভীর দুঃখের সাথে ঘোষণা করছে যে, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম ৩০ মে শনিবার ভোরে চট্টগ্রামে কিছু সংখ্যক দুষ্কৃতকারীর হাতে নিহত হয়েছেন। প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা রক্ষী ও অপর কয়েকজন সফরসঙ্গীও এই মর্মান্তিক ঘটনায় নিহত হন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় নিহত ব্যক্তিদের প্রকৃত সংখ্যা ও পরিস্থিতি সম্পর্কে সামগ্রিক তথ্য জানা যায়নি’।

 

এই শাহাদাৎ জনতাকে বেদনাবিধুর করে তোলে। এই শাহাদাত রাষ্ট্রযন্ত্রকে একরকম বিকল করে দেয়। এই শাহাদাত গণসংগঠন বিএনপিকে স্থবির করে তোলে। প্রাথমিকভাবে জিয়ার যথার্থ উত্তরাধিকারী সহধর্মিনী খালেদা জিয়াকে তার উত্তরাধিকারী ভাবাহলেও শোক বিহ্বল খালেদা জিয়াকে দিয়ে তা সম্ভব ছিল না। উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে প্রথমত রাষ্ট্র এবং পরবর্তীতে দলের কান্ডারী নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু দুর্বল ব্যক্তিত্বের কারণে বৃদ্ধ প্রেসিডেন্ট দৃশ্যত সেনাবাহিনী প্রধানের ক্রীড়ানক হয়ে পড়েন। যখন কঠোর সিদ্ধান্ত নিলেন অভ্যন্তরীন বিশ্বাসঘাতক সে প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে দেন। কৃত্রিম বিশৃংখলা, দুর্নীতির ডামাডোল এবং সন্ত্রাসের মহড়া দিয়ে অবশেষে সেনাবাহিনী প্রধান সেনা অভ্যুত্থান ঘটনা। মাত্র তিন মাস আগে নির্বাচিত একটি সরকারকে অযোগ্যতা, দুর্নীতি এবং সন্ত্রাসের কলঙ্কতিলক ধারণ করে অবশেষে বিদায় নিতে হয়। জাতি ষড়যন্ত্রের গভীর নিগড়ে নিপতিত হয়। ‘অবশেষে বিশ্বাসধাতকরা’ এরশাদীয় মন্ত্রিসভায় যোগ দেন, ক্ষতাকেন্ত্রিক রাজনীতির ধারক ও বাহকরা সুবিধাবাদী অবস্থান গ্রহণ করেন এবং কতিপয় ত্যাগী নিঃস্বার্থ নেতাকর্মী তোপের মুখে পড়েও সংগঠনকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। বিচারপতি সাত্তারের নেতৃত্ব মূলত বিএনপিকে পিছিয়ে দেয়। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিচারপতি সাত্তার যেমন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। বিএনপিকে ষড়যন্ত্র এবং নিষ্ক্রিয়তা থেকে রক্ষার জন্য সাধারণ মানুষের সুসুপ্ত ইচ্ছা, কর্মীদের দাবি এবং কিছু শীর্ষ নেতাদের উদ্যোগের ফলে বেগম খালেদা জিয়া অবশেষে বিএনপির নেতৃত্ব গ্রহণে সম্মত হন।

 

 

রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার আগমন

 

বেগম খালেদা জিয়া ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এদিনই তিনি বিএনপির প্রাথমিক সদস্য পদ লাভ করেন। তাঁর এ সিদ্ধান্তে বিএনপিতে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে যারা জিয়াকে ভালবাসতেন, তাদের মধ্যে। কিন্তু তাঁর এ সিদ্ধান্তে নাখোশ হলো কিছু কুচক্রী বিএনপি নেতা, যাদের সাথে তখন থেকেই গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন সেনাপতি এরশাদ। তারা দেখলো পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। বেগম খালেদা জিয়া নেতৃত্বে এলে সুবিধা হবে না। ফলে বেগম খালেদা জিয়া যাতে নেতৃত্বে না আসতে পারেন শুরু হলো গোপন ষড়যন্ত্র।

এদিকে বিএনপি চেয়ারম্যান নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হয় ১৯৮২ সালের ২১ জানুয়ারী। কে হবে চেয়ারম্যান? বিএনপির তরুণ নেতৃত্ব বেগম খালেদা জিয়াকে অনুরোধ করলেন দলের চেয়ারম্যান পদে দাঁড়াতে। সেদিকে ক্ষমতাসীন নেতৃত্ব প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে চেয়ারম্যান হিসেবে দেখতে চায়। তরুণ নেতাদের বক্তব্য হচ্ছে জিয়ার আদর্শ বিরোধিরা বিচারপতি সাত্তারকে ঘিরে রেখেছে। বিচারপতি সাত্তার চেয়ারম্যান হলে জিয়ার আদর্শের বিচ্যুতি ঘটবে। এ অবস্থায় তরুণ নেতৃত্বের দাবির মুখে বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচন কমিশনে চেয়ারম্যান পদের জন্য মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। তাঁর পক্ষে ৫ জানুয়ারি রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে মনোনয়নপত্র জমা দেয়া হয়। মনোনয়নপত্র প্রস্তাব করেন বিএনপির মঠবাড়িয়া (পিরোজপুর) থানা শাখার সভাপতি প্রবীণ নেতা শামসুল হক ও সমর্থক নগরকান্দা (ফরিদপুর) থানা কমিটির সাধারণ সম্পাদক বদিউজ্জামান মোল্লা। এদিকে বিচারপতি সাত্তারও চেয়ারম্যান পদের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেন। এর ফলে এক বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। বিচারপতি সাত্তার দুবার বেগম খালেদা জিয়ার বাসায় যান এবং দলের বিষয় নিয়ে আলাপ করেন। বেগম খালেদা জিয়া তাঁকে দলের তরুণ নেতৃত্বের মনোভাবের কথা জানান। এসময় বিচারপতি সাত্তার বেগম খালেদা জিয়াকে দলের সহ - সভাপতির পদ এবং দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানান। কিন্তু বেগম জিয়া ব্যক্তিগত কারণে তা গ্রহণ করেননি। অবশেষে বিচারপতি সাত্তারের সাথে দীর্ঘ আলোচনার পর বেগম খালেদা জিয়া চেয়াম্যান পদ থেকে তার প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেন। ৬ আগষ্ট চূড়ান্ত বাছাইয়ের আগেই তিনি প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করেন। ফলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় বিচারপতি সাত্তার দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

বেগম খালেদা জিয়া তাকে সমর্থনকারী নেতাদের জানান, দলের বৃহত্তর স্বার্থে এবং বিচারপতি সাত্তারের প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত হয়ে তিনি প্রার্থীতা প্রত্যাহার করছেন। বিচারপতি সাত্তার তাকে কথা দিয়েছেন, দলকে তিনি ঐক্যবদ্ধ রাখবেন। তিনি আরও বলেন,  দল বা কোন পদের প্রতি তার কোন লোভ নেই। তিনি চান, বিএনপি যেন বিভক্ত না হয়। তার এই সিদ্ধান্ত তখনই প্রশংসিত হয়েছিল ১৯৮২ সালের ৮ জানুয়ারি বেগম খালেদা জিয়া সংবাদপত্রে এক দীর্ঘ বিবৃতির মাধ্যমে রাজনীতিতে পদার্পনে তার সিদ্ধান্তের কথা দেশবাসীকে জানান। বিবৃতিটি হলো: প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি শোষণহীন, দুর্নীতিমুক্ত আত্মনির্ভরশীল দেশ গঠনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠন করেছিলেন। এই দলকে সুসংগঠিত ও শক্তিশালী করার জন্য তিনি গত কয়েক বছর ধরে কী অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন তা আপনারা জানেন। বিগত ৩০ মে ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে শাহাদৎ বরণের পূর্ব মুহূর্তেও তার এই প্রাণপ্রিয় দলের সাংগঠনিক কাজে তিনি নিয়োজিত ছিলেন।

বিগত কিছুকাল যাবত আমি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের কার্যক্রম গভীরভাবে অবলোকন করে আসছি। আমি অত্যন্ত দু:খের সাথে লক্ষ্য করছি যে, দলের ভেতর বিভিন্ন বিষয়ে ভূল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে, যা দলীয় ঐক্য ও সংহতি বিপন্ন করতে পারে।  দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এবং দলীয় ঐক্য ও সংহতি রক্ষার্থে আমাকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বিভিন্ন মহল রাজনীতিতে অংশ নিয়ে বিএনপির দায়িত্ব ভার গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। এমতাবস্থায় সব দিক বিবেচনা করে দলের বৃহত্তর স্বার্থে আমি বিএনপিতে যোগ দিয়েছি এবং দলের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হয়েছি। আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, শহীদ জিয়ার গড়া এই দলের ঐক্য এবং সংহতি বজায় রাখা। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে নি:স্বার্থভাবে কাজ করে যাওয়া। এরই মধ্যে মহামান্য প্রেসিডেন্ট সাত্তারের সাথে দেশ ও দলের বিষয়ে  কিছু আলোচনা হয়েছে। তিনি আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন যে, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া প্রণীত ১৯ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবেন এবং বিএনপির ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখার জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। তার অনুরোধ ও এই আশ্বাসে আমি চেয়ারম্যান প্রার্থী পদ থেকে মনোনয়ন প্রত্যাহার করছি। দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের প্রতি আমার আবেদন, তারা যেন নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে নি:স্বার্থভাবে শহীদ জিয়ার অনুসৃত কর্মধারা ও আদর্শের ভিত্তিতে শোষণহীন দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও ১৯ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। আমি তাদের সাথে সবসময় থাকবো।

দেশের নির্বাচিত  প্রেসিডেন্ট হিসাবে এবং দলের চেয়ারম্যান হিসাবে বিচারপতি সাত্তার তার দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করে যাচ্ছেন। বেগম খালেদা জিয়া নানা বিষয়ে পরোক্ষাভাবে তাকে সহায়তা করছেন। এ অবস্থায় সেনা ছাউনিতে ঘাপটি মেরে বসে থাকা কুচক্রি সেনা প্রধান এরশাদ দেখলো বেশীদিন এভাবে চলতে থাকলে তার অভিলাষ চরিতার্থ করা যাবে না। এতদিন বিচক্ষণতার সঙ্গে দাবার গুটি চাল দিয়ে একটির পর একটি ঘটনা যে তিনি ঘটিয়েছেন, তার মুখোশ উম্মোচিত হয়ে যাবে।

 

তাই আর বিলম্ব নয়, ক্ষমতায় সেনাবাহিনীর অংশীদারিত্ব চেয়ে তিনি একটি বিবৃতি দিলেন। এ নিয়ে বেশ কিছুদিন বিতর্ক হলো। ইতোমধ্যেই পরিকল্পিতভাবে আইন শৃঙ্খলাজনিত কিছু ঘটনা ঘটানো হলো। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এল সেই কলঙ্কিত দিন। জেনারেল এরশাদ রাতের অন্ধকারে বঙ্গভবনে ঢুকে বন্দুকের নলের মুখে বিচারপতি সাত্তারের কাছ থেকে কেড়ে নিল ক্ষমতা। বন্দুকের মুখে তাকে দিয়ে দেয়ানো হলো জাতির উদ্দেশ্যে টেলিভিশন-রেডিওতে ভাষণ। বলানো হলো দুর্নীতি এতোই ব্যাপক হয়েছে যে, তার পক্ষে দেশ পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে না। বৃহত্তর স্বার্থেই সেনাবাহিনীকে ডাকা হয়েছে। কিন্তু এই ঘটনা ছিল নিতান্তই এরশাদের ভাঁওতাবাজি। সেদিন বার্ধক্যের পরিণতিতে বিচারপতি সাত্তারের পক্ষে কিছুই করার ছিল না।

 

তবে বিচারপতি সাত্তার এক বিবৃতির মাধ্যমে  জাতির সামনে তুলে ধরেন কিভাবে এরশাদ তাঁর কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়। বিবৃতিতে বিচারপতি সাত্তার বলেন, ‘দেশের জনসাধারণের ভোটে আমি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আমি দায়িত্ব পেয়েছিলাম। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষা, গ্রগতিশীল অর্থনৈতিক কাঠামোতে এবং সুস্থ্য রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমরা সবাই যখন সরকারি দায়িত্বে ব্যস্ত ছিলাম, সেই মৃহূর্তে রাতের অন্ধকারে আচমকা অস্ত্রের মুখে আমার কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয় এরশাদ। বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে দেশ পরিচালনায় আমার সরকারের মাত্র চার মাস হয়েছিল, আজ স্পষ্টভাবে বলছি, অবৈধ সরকার ও তার তল্পিবাহকরা জনগণকে ধোকা দেয়ার জন্যে এবং তাদের কুকীর্তি ঢাকা দেয়ার জন্য মিথ্যার পর মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করেছে। জাতির সামনে আমি যে রেডিও-টিভিতে ভাষণ দিয়েছিলাম, সেটি আমার ছিল না। অস্ত্রের মুখে এরশাদ আমাকে দিয়ে বলিয়েছে, জাতি আজ মহাপরীক্ষায় অবতীর্ণ। একদিকে বাক-স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন, অন্যদিকে এরশাদের স্বৈরাচারী সমর্থনহীন অবৈধ সরকার স্থায়ী করার প্রচেষ্টা। আমি জনগণের কাছে স্পষ্ট ভাষায় বরতে চাই, আমি ও আমার সহকর্মীরা যখন দেশকে সুষ্ঠভাবে দেশ পরিচালনা করছিলাম, তখন কোন কারণ ছাড়াই গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এরশাদ শাহী ক্ষমতা হরণ করে। আমি এও বলতে চাই-নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা সত্য-মিথ্যার বিচার করবেন”।

 

১৯৮২ সালের ১৬ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে খালেদা জিয়া স্বাক্ষরিত শত শত কার্ড বিতরণ করা হয়। এ বছরের ৩০ মে শহীদ জিয়ার প্রথম শাহাদাৎবার্ষিকীতে মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদনে উপস্থিত হাজার হাজার নেতকর্মীর প্রতি খালেদা জিয়া তাঁর তাৎক্ষণিক ভাষণে ‘শোককে শক্তিতে’ পরিণত করার আহ্বান জানান। শহীদ জিয়ার আদর্শের অনুসারী সকল নেতা-কর্মীদের তিনি শপথ বাক্য পাঠ করান। এর পরপরই পুলিশ সমাবেশে লাঠিচার্জ করে এবং কতিপয় ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার করে। বিকেলে খালেদা জিয়ার সেনানিবাসের বাসভবনে অনুষ্ঠিতব্য মিলাদ মাহফিলে আসতে নেতা-কর্মীদের বাধা দেয়া হয়। এদিকে বিভিন্ন সেনানিবাসে গ্যারিসন মসজিদগুলোতে কর্তৃপক্ষের আদেশ নিষেধের অপেক্ষা না করে সাধারণ সৈনিকরা মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে।

 

 

মজিদ খান শিক্ষানীতি বিরোধী আন্দোলন

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যে গণতন্ত্র এদেশে চালু করেছিলেন, এরশাদের ক্ষমতা দখল ও সামরিক শাসন জারির ফলে সেই বহুদলীয় গণতন্ত্র আবার নির্বাসিত হলো। গণতন্ত্র পিষ্ট হলো বুটের তলায়। ক্ষমতা কুক্ষিগত করেই এরশাদ ক্ষান্ত হলেন না। বিএনপিকে ধ্বংস করার জন্য রাজনীতিকে কলুষিত করার জন্য শুরু করলেন গভীর ষড়যন্ত্র। দেশে সৃষ্টি হয় এক গভীর সঙ্কট। জনগণের নির্বাচিত সংসদ বাতিল ও সংবিধান স্থগিত করে সামরিক শাসনের আবরণে সৃষ্টি করা হয় রাজনৈতিক অচলাবস্থা। রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। হুলিয়া জারি করে নির্যাতন, জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করে নিপীড়নের স্ট্রিম রোলার চালানো হয়। হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। সামরিক সরকারের একমাত্র টার্গেটে পরিণত হলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। শুধু বিএনপিরই তিন হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে সামরিক আদালতে প্রহসনমূলক বিচার করা হলো। আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ ছিল না। সামরিক শাসন জারির পর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও তার দল বিএনপি গৃহীত সব বৈপ্লবিক কর্মসূচি স্থগিত করল এরশাদ, অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বৃদ্ধি ও অপকিল্পিত তৎপরতার ফলে জনজীবনে নেমে এল অসহনীয় দুর্ভোগ। ১৯৮২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর শিক্ষামন্ত্রী ড. আবদুল মজিদ কান মার্শাল ল’স্টাডি কমিটির সুপারিশের আলোকে নতুন শিক্ষানীতি ঘোষণা করেন। এ শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক পর্যায় থেকে আরবি ও ইংরেজি বাধ্যতামূলক করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। একই সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে রাজনীতিকে দূরে রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। এ শিক্ষনীতির বিরোধিতা করে বিএনপি। নীতিনির্ধারক মহলের সম্মতিতে আন্দোলনের কৌশল হিসেবে ছাত্রদলের নেতৃত্বে আন্দোলনের সূচনা করার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল অবিলম্বে একটি শক্তিশালী বিবৃতি প্রদান করে। অন্যান্য ছাত্র সংগঠনও অনুরূপ বিবৃতি প্রদান করে। দেশের বুদ্ধিজীবীরা শিক্ষানীতির বিরোধিতা করে বিবৃতি প্রদান করেন। স্বৈরাচারী বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরি হতে থাকে।

 

 

হাইকোর্ট বিকেন্দ্রীকরণ বিরোধী আন্দোলন

 

ক্ষমতায় আসার কয়েক মাসের মধ্যে সামরিক সরকার হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ করে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বাংলাদেশ হাইকোর্ট ভেঙে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, যশোর ও বরিশালে বেঞ্চ স্থাপন করা হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, মামলার স্তুপে জমে থাকার কারণে বিচারে বিলম্ব ঘটে এবং মানুষের দুঃখ ও দুর্ভোগ বাড়ে। সুতরাং অপেক্ষমান মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে। সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করে। তারা একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করে আন্দোলনকে বেগবান করার সিদ্ধান্ত নেয়। বিএনপি শীর্ষ নেতৃত্ব আইনজীবীদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে। বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা এ আন্দোলনে যোগদান করেন। সরকার আন্দোলনকে কঠোরভাবে দমন করার সিদ্ধান্ত নেয়। শীর্ষস্থানীয় ১৩ জন আইনজীবীকে গ্রেফতার করা হয়। বাদানুবাদ, আন্দোলন এবং অবশেষে আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে আপাতত আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু ভবিষ্যৎ আন্দোলনের শক্ত বীজ রোপিত হয়।

 

গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূত্রপাত :  স্বৈরশাসন বিরোধী প্রথম মিছিল

 

এ দেশে ছাত্ররাই প্রতিটি আন্দোলনে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে। এরশাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রাথমিক পর্যায়ে ছাত্র নেতারা এরশাদ বিরোধী একটি সমন্বিত এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য নিজেদের মধ্যে আলা আলোচনা ও পারিশার্শ্বিক প্রস্ততি গ্রহণ করে। তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, ১৯৮২ এর ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসে তারা প্রথম বারের মত রাজপথে নামে। এ সময় ফিলিস্তিনে ইসরাইলী বর্বরতা ছাত্রদল রাজপথে নামতে কৌশলগতভাবে সহায়ক হয়। বাংলাদেশে অধ্যয়নরত ফিলিস্তিনী ছাত্ররা বাংলাদেশের ছাত্রনেতাদের সাথে আলোচনাক্রমে যৌথ মিছিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ঠিক হয় যে পরদিন জুমআ তুল বিদা অর্থাৎ রমজান মাসের শেষ শুক্রবার জুমআর নামাজের পর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম থেকে প্রতিবাদ মিছিল করে মার্কিন দূতাবাসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হবে। ওই দিন ছাত্ররা নামায আাদয় করে মিছিল নিয়ে আদমজি কোর্টে অবস্থিত আমেরিকান সেন্টারের দিকে অগ্রসর হয়। মিছিলকারীরা মার্কিন ও ইসরাইল বিরোধী শ্লোগান দেয়। এরশাদের সামরিক আইনজারির পর এটাই ছিল প্রথম রাজপথে মিছিল। লোকজন হতচকিত হয়। প্রশাসন হতবাক হয়। গোয়েন্দারা হয়রান হয়ে পড়ে। মিছিলটি শান্তিপূর্ণভাবে সমাপ্তির কথা ছিল। কিন্তু আকস্মিকভাবে মিছিলে পুলিশ হামলা করে। এরশাদ বিরোধী শ্লোগান উচ্চারণ করে ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

 

পরবর্তি শিক্ষাদিবস পালনের জন্য ছাত্রসমাজ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সামরিক শাসনে ৫ জনের বেশি জমায়েত নিষিদ্ধ ছিল। এমনকি মিলাদ মাহফিল করতেও সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়। ছাত্ররা একটি মধ্যবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তারা একটি মৌন মিছিল করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। তাও আবার ক্যাম্পাসেই সীমাবদ্ধ থাকবে। সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ এসব জেনে হল প্রাধ্যক্ষদের ডেকে পাঠায়। তারা প্রাধ্যক্ষদের প্রতি ন্যূনতম সৌজন্য প্রকাশ না করে আদেশের ভঙ্গিতে কথা বলে। এতে প্রকারান্তরে আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ছাত্ররা বিনীতভাবে শিক্ষা দিবস পালনে অনড় থাকে। মৌন মিছিলের কর্মসূচি অপরিবর্তিত থাকে। ১৪টি ছাত্র সংগঠন কলাভবনে মিছিল করে। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সম্মুখ ব্যানারে লেখাছিল: এরশাদের পতন চাই। এরশাদের পতন চেয়ে এটিই সম্ভবত প্রথম সাহসী উচ্চারণের স্বাক্ষর। শিক্ষাদিবসের পূর্বদিনের এসব কর্মসূচি শেষে ছাত্ররা শিক্ষা দিবসে (১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৮২) শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পনের সিদ্ধান্ত নেয়। পুলিশ বাধা প্রদান করে। একজনকে গ্রেফতার করে। ছাত্ররা জগন্নাথ হলের শহীদ মিনারে পুষ্প অর্পন করে। এসব সামান্য সামান্য ঘটনা অসামান্যভাবেই ছাত্রদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। ভবিষ্যতে ছাত্র আন্দোলনের জন্য এসব ছোট ছোট ঘটনা বড় অভিঘাতের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

 

 

 স্বৈরশাসন বিরোধী দ্বিতীয় মিছিল

 

১৯৮২ সালের ৭ নভেম্বর বেগম খালেদা জিয়া ছাত্রদল নেতকর্মীদের শপথ বাক্য পাঠ করান এবং সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। ওই সভা পুলিশ ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল পরের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে এক প্রতিবাদ মিছিল বের করে। জাসদ ছাত্রলীগও ৭ নভেম্বর উদযাপন উপলক্ষে পরের দিন অর্থাৎ ৮ নভেম্বরে (১৯৮২) ক্যাম্পাসে মিছিল করে। শান্তিপূর্ণ দুটো মিছিলেই পুলিশ হামলা করে। পুলিশের উস্কানিমূলক আচরনে ছাত্রসমাজ উত্তেজিত হয়ে উঠে। যেটি ছিল দলীয় বিষয় তা দল মত নির্বিশেষে যখন ছাত্রদের সমর্থন ধন্য হয়ে ওঠে। শুরু হয় সংঘর্ষ। রীতিমত খন্ড যুদ্ধ। কাঁদানে গ্যাস এবং গুলি সমগ্র ক্যাম্পাস কাঁপিয়ে তোলে। এ সময় শিক্ষক-লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটে। পুলিশ কলাভবন অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নারকীয় অত্যাচার করে। ছাত্রীদের প্রতিও অমর্যাদাকর আচরণ করা হয়। সংঘর্ষ ক্যাম্পাসের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ সাংবাদকিদেরও নির্যাতন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি স্বৈরাচারী সরকারের এ নির্যাতনের কঠোর নিন্দা করে এবং নজিরবিহীন বলে অভিহিত করে। বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৮২ সালের ১৪ নভেম্বর খুলে দিলেও ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে। অপরাজয়ের বাংলার পাদদেশে ১৪ ছাত্র সংগঠন এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। এতে ডাকসু, বাকসু এবং অন্যান্য ছাত্র নেতারা বক্তব্য রাখেন। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল মধুর কেন্টিনে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। উভয় সভাতেই ২৯ নভেম্বর ১৯৮২ দাবি দিবস পালিত হবে বলে সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়।

 

 

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত

 

স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে অব্যাহত রুপ দেয়ার জন্য বিএনপি এর শীর্ষ নেতৃত্ব পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল আন্দোলকে বেগবান করে। ২১ নভেম্বর ১৯৮২ এক সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়। ১৪টি ছাত্র সংগঠন এতে শামিল হয়। একটি যৌথ বিবৃতি বিরতণ করা হয়। ছাত্ররা সামরিক সরকারকে ‘সেলফ স্টাইল’ বলে অভিহিত করেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শিক্ষা বিষয়ক দাবির সাথে সাথে মননীতির তীব্র প্রতিবাদ করে এবং সামরিক শাসন প্রত্যহারের দাবি জানায়। এই প্রথম কোন সংগঠন বা গোষ্ঠীর তরফ থেকে সামরিক শাসন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া হয়। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল আরও বৃহত্তর ঐক্যের কৌশলগত কারণে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে শামিল না হলেও যৌক্তিক সাহায্যে সহাযোগিতা অব্যাহত রাখে। ২৯ নভেম্বর ১৯৮২ সারা দেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে দাবি দিবস পালিত হয়। বটতলায় অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে স্বৈরশাসনকে উৎখাতের আহ্বান জানায়। তারা অবহিত করে যে ইতোমধ্যে তাদের অনুসরণে শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনগুলো একত্র হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে একই দাবিতে একইভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানায়। ছাত্ররা ১৩ ডিসেম্বর ১৯৮২ শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ধর্মঘট আহ্বান করে।

 

 

ছাত্রদলের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়াকে আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব গ্রহণের আমন্ত্রণ

 

১১ ও ১২ ডিসেম্বর ১৯৮২ ঢাকায় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় শিক্ষানীতি বিরোধী আন্দোলনকে প্রকারান্তরে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে রুপ দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্তক্রমে বিএনপির নেতৃত্বের জন্য ছাত্রদলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বেগম খালেদা জিয়াকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সভার ফলাফল সম্পর্কে যথারীতি বিএনপি নেতৃবৃন্দকে অবহিত রাখা হয়। ৮২ এর বিজয় দিবসে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সাংবাদিক সম্মেলন করে ১১ দফা দাবি উত্থাপন করে। সামরিক শাসন প্রত্যাহার, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, শিক্ষানীতি বাতিল এবং শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজিত সমস্যাসমূহ সমাধানের দাবি জানানো হয়।

 

এ সময় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তথা অন্যান্য ছাত্র সংগঠন ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে বেগবান করার তাগিদ অনুভব করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ১৯৮৩ সালের ১১ জানুয়ারি সচিবালয় ঘেরাও এর কর্মসূচি গ্রহণ করে। পরবর্তী সময়ে পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে ১৪ ফেব্রুয়ারি সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি গৃহিত হয়।

 

স্বৈরাচারী কর্তৃক সুবিধা এবং পদের মাধ্যমে বিভক্তির চেষ্টা এ সময়ের একটি ন্যাক্কারজনক ঘটনা। ছাত্রনেতাদের সাথে সামরিক শাসনের বিভিন্ন এজেন্সী যোগাযোগ করে। জেনারেলরা কথা বলে। এমনকি প্রেসিডেন্ট নিজে সরাসরি টোপ ফেলেন। মধ্যস্থাকারী ভাইস চ্যান্সেলর ফজলূল হালিম চৌধুরী বিব্রত হন। ডাকসু ভিপি জিয়াউদ্দিন বাবলু পুরুস্কৃত হন। মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেন। সাধারণ ছাত্ররা নানা ধরনের বিভক্তি এবং গুজবকে অগ্রাহ্য করে সচিবালয় ঘেরাও আন্দোলনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করে।

 

মধ্য ফেব্রুয়ারির আন্দোলন

 

ছাত্রদের প্রতি সরকারী হুঁশিয়ারী, ছাত্র নেতৃত্বের প্রতি পদ প্রলোভন, বুদ্ধিজীবীদের একুশে ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রিক ঐক্য এবং খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে পদার্পনের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে সঞ্চারিত আশা আস্থার প্রেক্ষাপটে মধ্য ফেব্রুয়ারি ৮২ এর ছাত্র গণআন্দোলন অনুষ্ঠিত হয়। ইতোমধ্যে অন্য বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাম ধারার রাজনৈতিকগুলো ১৫ দলীয় জোট গঠন করে। উভয় রাজনৈতিক শক্তিই যৌথভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের যৌক্তিকতা অনুভব করে। এতদুদ্দেশ্যে গঠিত জাতীয় কমিটিতেও জাতীয়তাবাদী শক্তির যথার্থ প্রতিনিধিত্ব ছিল। মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়। বিশেষ করে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের বলে ব্যাপক কর্মতৎপরতা পরিলক্ষিত হয়। ১২ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদলের পক্ষ থেকে এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে হলে এবং রাজধানীর প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিপুল অংশগ্রহনের মাধ্যমে প্রস্তুতিমূলক মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।

 

১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০ টার মধ্যে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় সমবেত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারিদিকের রাস্তা পুলিশ বন্ধ করে দেয়। দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করা হয় শিক্ষাভবনের সামনে। হাইকোর্ট মোড়ে বিডিআর বেরিকেড সৃষ্টি করে। দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে হাজার হাজর ছাত্র-ছাত্রী মিছিল নিয়ে শিক্ষাভবনের দিকে এগুতে থাকে। দোয়েল চত্বর অতিক্রম করতে না করতেই পুলিশ ছাত্র মিছিলে টিয়ার গ্যাস ও গরম পানি ছিটাতে থাকে। তারপর লাঠিচার্জ করে। ছাত্ররা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। ছাত্রদের সাথে সংঘর্ষে পুলিশ পিছু হটে। কোনভাবেই ছাত্রদের হটাতে না পেরে পুলিশ গুলিবর্ষন শুরু করে।

 

এই মধ্যযুগীয় তান্ডবে লুটিয়ে পড়ে ৭ জন। জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, আইউব, ফারুক, দিপালী সাহা শাহাদাত বরণ করেন। আহত হয় অগণিত। পুলিশ এতটা নির্মম ও বেপরোয়া হয়ে ওঠে যে লাশগুলো তুলে নেয়। এমনকি ক্যাম্পাস থেকেও লাশ ছিনিয়ে নেয়। হলে হলে তল্লাশি চালায়। সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘিরে তান্ডব চালায়। গ্রেফতারকৃত শীর্ষ ছাত্র নেতৃবৃন্দসহ অসংখ্য ছাত্রকে শাহবাগ আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে যায়।  সেখানে ছাত্রদের সাথে চরম অমানবিক ব্যবহার করা হয়। এক পর্যায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মেয়েদের হলে প্রবেশ করে। তাদের সাথে অমর্যাদাকর আচরণ করে। সব ঘটনা অবহিত হওয়ার পরপরই বেগম খালেদা জিয়া ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। থার্ড গেটে তাঁর গাড়ি ফিরিয়ে দেয়া হয়। তিনি বুদ্ধি করে বনানীর গেট দিয়ে ক্যাম্পাসের দিকে আসতে থাকলে শাহবাগ মোড়ে গাড়ির গতিরোধ করে দাঁড়ায় সিপাহীরা। এবার কৌশল গ্রহণ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে লাশের সামনে হাজির হন। শেখ হাসিনাসহ অন্যান্য জাতীয় নেতাও সেখানে যান এবং জানাজায় অংশ গ্রহণ করেন।

 

১৪ ফেব্রুয়ারি নির্নম হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ১৫ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা শহরের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্ররা মিছিল সহকারে রাজপথে নেমে আসে। রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে ছাত্রদের সাথে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর রীতিমত খন্ডযুদ্ধ হয়। এসব ঘটনায় কমপক্ষে ১৫ জন নিহত হয়। আগের মতই পুলিশ লাশ ছিনিয়ে নেয়। এরপর আন্দোলন ছড়িয়ে যায় বাংলাদেশের সর্বত্র। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উত্তাল হয়ে ওঠে। চট্টগ্রামে ১০ জনের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পাওয়া যায়। সরকার ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে।

 

ঢাকায় সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত কারফিউ জারি হয়। অনেক দিন পর্যন্ত এ কারফিউ বলবৎ থাকে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করে। ১ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে হরতালের ডাক দেয়। আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য ঢাকা শহরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক গ্রেফতার করা হয়।

 

ঘটনা পরম্পর রাজনৈতিক তাৎপর্য বিশ্লেষনের জন্য জাতীয় নেতৃবৃন্দ স্ব স্ব সীমাবদ্ধতায় বৈঠক করেন। জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ ঘটনাবলীর সাথে সার্বক্ষনিকভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। বিশেষ করে বেগম খালেদা জিয়ার সাথে ছাত্রদলের নেতৃবৃন্দের ঘনিষ্ট যোগাযোগ এবং নির্দেশনা অব্যাহত ছিল। অন্যান্য দলীয় নেতৃবৃন্দও একইভাবে ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করছিলেন। ১৫ দলীয় জোট নেতৃবৃন্দ পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে যখন বৈঠক করছিলেন তখন তাদের সকল শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। একই সাথে কর্নেল অলিসহ জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দকেও কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়।

 

একুশে ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে আন্দোলন আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। বস্তুত একুশে উদযাপনকে কটাক্ষ করে প্রেসিডেন্ট এরশাদের অযাচিত মন্তব্য আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগায় ছাত্রনেতারা পলাতক। নেতৃবৃন্দ কারাবন্দী। মামলা এবং হামলায় বিপর্যস্ত দেশ। সামনে কঠিন সময়। তবুও বেগম খালেদা জিয়া শহীদ মিনারে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বেশ আগে থেকেই । গৃহিত পরিকল্পনা মোতাবেক নেতা-কর্মীদের বলাকা সিনেমা হলের সামনে উপস্থিত হতে বলেন। সকাল সাড়ে আটটায় মৌন মিছিলটি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পন করে। বিকেলে জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস)-এর উদ্যেগে রমনার বটমূলে এক আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। বেগম খালেদা জিয়া এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন।

 

 

 বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম রাজনৈতিক বক্তৃতা

 

বেগম জিয়া সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক বক্তৃতা দিলেন। ইতোপূর্বে ১৯৮২ সালের ৭ নভেম্বর জিয়ার মাজারে তার বক্তৃতা তাৎক্ষনিক এবং অনানুষ্ঠানিক। একজন ‘গৃহবধু’ খালেদা জিয়া সবাইকে অবাক করে দিয়ে উদ্দীপনাময় বক্তৃতা করেন। আলোচনা সভায় তিনি এককভাবে সামরিক জান্তা অস্ত্রের জোরে নির্বাচিত বিএনপি সরকারকে উৎখাত করে এর বর্ণনা দেন। তিনি বিএনপি এবং অঙ্গ সংগঠন সমূহের কর্মীদের দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি মধ্য ফেব্রুয়ারি নির্মম হত্যাকান্ড এবং পৈশাচিক অত্যাচারের তীব্র নিন্দা করেন। তিনি আবেগপূর্ণভাবে বলেন আপনাদের আন্দোলনের কাফেলায় আমি শরীক হতে চাই। স্বৈরাচারীর তখতে তাউসকে খান খান করে ভেঙ্গে দিন। আন্দোলনের মধ্যে এই সরকারকে উৎখাত করতে হবে। খালেদা জিয়া বক্তৃতা দিয়ে চলে যাবার পরপরই পুলিশ সভা ভেঙ্গে দেয়। জাসাস নেতৃবৃন্দকে অপমান অপদস্ত করে। উল্লেখ্য যে, কৌশলগত কারণে কেবল অনুষ্ঠান শুরুর পূর্বাহ্নে খালেদা জিয়ার আগমনের কথা ঘোষণা করা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় রমনার বটমূল। ২২ ফেব্রুয়ারি সরকার এক সার্কুলার জারি করে যে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজনৈতিক চর্চা চলবে না। ২৫ ফেব্রুয়ারি  ’৮৩ গণআন্দোলনকে নস্যাত করার জন্য সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে।

 

একুশে ফেব্রুয়ারিতে খালেদা জিয়ার প্রকাশ্য রাজনীতি চর্চা তৎকালীন সময়ে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। খালেদা জিয়ার সাহস দৃঢ়তা এবং দূরদৃষ্টি সরকারকে বিচলিত করে তোলে। বিএনপির নেতৃত্বে যাতে খালেদা জিয়া না আসতে পারে সেজন্য ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করা হয়। বিএনপিকে বিভক্তির দিকে ঠেলে দেয়া হয়। একদল সুবিধাবাদী প্রকাশ্যে সুবিধা: পদ মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করে। অপর সুবিধাবাদীরা ঘাপটি  মেরে থেকে দলকে অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র দ্বারা নস্যাৎ করার জন্য। খালেদা জিয়া গৃহবধু, রাজনীতিতে অনভিজ্ঞা, জিয়া তাঁকে রাজনীতিতে টেনে আনেননি-বৃহত্তর নেতা-কর্মী মহলে কোন কুযুক্তিই খালেদা জিয়ার সততা কর্মতৎপরতা, অপরিসীম নিষ্ঠা, স্বতঃস্ফুর্ত সাংগঠনিক দৃঢ়তা এবং পরিশ্রম পরাকাষ্ঠাকে ম্লান করতে পারেনি। অবশেষে ১৯৮৪ সালের ১২ জানুয়ারি খালেদা জিয়া জাতীয়তাবদী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন মনোনীত হন।

 

 

বিএনপির নেতৃত্বে খালেদা জিয়া

 

বিচারপতি সাত্তার আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির চেয়ারম্যান ছিলেন। তার অসুস্থতা অকর্মণ্যতা এবং অযোগ্যতা ধীরে ধীরে বিএনপির প্রভাব বলয় থেকে তাকে দুরে সরিয়ে দেয়। ইতোমধ্যে খালেদা জিয়া স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদনে নেতৃত্ব দেন। স্বাধীনতা দিবসের আলোচনা সভায় হৃদয়গ্রাহী ভাষণ দেন। এরপর থেকে কার্যত: তিনিই দল পরিচালনা করতে থাকেন। বিএনপিকে সুসংগঠিত করবার জন্য তিনি গোটা বাংলাদেশ সফর করার চেষ্টা করেন।

 

এদিকে বেগম খালেদা জিয়ার সক্রিয় রাজনীতিতে পদার্পণ এবং সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার খবরে এরশাদ ভীত হয়ে পড়ল। কুচক্রী জেনারেল আবার শুরু করল ষড়যন্ত্র। গোপনে বিএনপির কিছু নেতার সাথেই চললো আঁতাত। এরই মধ্যে এরশাদ সামরিক শাসন জারির এক বছর সাতদিন পর ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল ঘরোয়া রাজনীতি করার অনুমতি দিলেন। এ অবস্থায় দলের কর্মসূচি প্রনয়ন ও গোটা পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্যে বিএনপির চেয়ারম্যান বিচারপতি আবদুস সাত্তার ১ এপ্রিল দলের বর্ধিত সভা আহ্বান করেন। ইতিমধ্যেই বেগম খালেদা জিয়ার সিনিয়র সহ-সভাপতি মনোনয়নের খবরে বিরোধিতা করলেন দলের হুদা মতিন’ চক্র যারা গোপনে জেনারেল এরশাদের সাথে আঁতাত করেছে। তাদের মাধ্যমে এরশাদ চেষ্টা করলো যাতে বেগম জিয়া রাজনীতিতে না আসেন। কিন্তু তা সফল হয়নি। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে বেগম জিয়াকে সক্রিয় রাজনীতিতে নামতেই হবে। ফলে বিফল হয়ে প্রকাশ্যেই তারা বিরোধিতা শুরু করল। ‘হুদা-মতিন’ গ্রুপ ১৯৮৩ সালের ২  এপ্রিল গাবতলি (ঢাকা) বিউটি সিনেমা হলে কনভেনশন আহ্বান করল।

 

১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল থেকে ঘরোয়া রাজনীতি শুরু হলো। নয়াবাজার ইউসুফ মার্কেট কার্যালয় বিএনপির বর্ধিত সভা শুরু হলো। বর্ধিত সভার উদ্বোধন করে দলের চেয়ারম্যান বিচারপতি আবদুস সাত্তার বলেন, কিছুসংখ্যক লোক দলের মুলতবী সভা আহ্বান করেছে। আমি তাদের বলেছি কোন অভিযোগ থাকলে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী  সমাধান করা যাবে। কিন্তু তবুও তারা তলবী সভা করছে। ফলে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে দলকে নিয়ে তারা ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। এর পরই বর্ধিত সভায় ভাষণ দেন দলের সদ্য মনোনীত সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান বেগম খলেদা জিয়া। দলীয় নেতা ও কর্মীদের উদ্দেশ্যে এটাই রাজনীতিতে এসে প্রথম তাঁর আনুষ্ঠানিক বক্তব্য। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ন্যায়ভিত্তিক ও শোষনহীন সমাজ প্রতিষ্ঠাই হচেছ শহীদ জিয়াউর রহমানের আদর্শ। এজন্য ১৯ দফা সনদ তিনি দিয়েছিলেন। দিয়েছিলেন উৎপাদনের রাজনীতি। আমি সেই জননেতার সহধর্মিনী খালেদা জিয়া। শহীদ জিয়ার আদর্শ ও পথনির্দেশনার সফল বাস্তবায়নই আমার জীবনের উদ্দেশ্য। আমি এ দেশের সকল দেশপ্রেমিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর কাছে আহ্বান জানাচ্ছি, আসুন বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ইনশাল্লাহ জয় আমাদের হবেই।”

 

দলের ভাঙনের কথা উল্লেখ করে বেগম জিয়া বলেন, “আমাদের কিছু সাথী আলাদা বৈঠকে বসে দলের মধ্যে যে ভাঙন বা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন তা দুঃখজনক। এ পার্থক্য কোন আদর্শগত নয়। আসুন আমরা সকল বিভেদ বৈষম্য ভুলে গিয়ে শহীদ জিয়ার মহান আদর্শ বাস্তবায়ন করি।’ বর্ধিত সভায় এদিন আবদুল মোমেন খান, প্রফেসর বদরুদ্দোজ চৌধুরী, মীর্জা গোলাম হাফিজ, আ: হামিদ, আ: আলিম, মুস্তাফিজুর রহমান, ব্যারিষ্টার আ: হক, জসিম উদ্দিন সরকার, বেগম তাসলিমা আবেদ, কাজী গোলাম মাহাবুব, হারুনুর রশীদ, এল কে সিদ্দিকী, রফিকুল ইসলাম মিয়া, ফেরদৌস আহমদ কোরেশী, কাপ্টেন আ: হালিম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। বর্ধিত সভায় ২৫১জন সাবেক এমপির মধ্যে ১৮২ জন এবং জাতীয় কমিটির ১৮০ জনের মধ্যে ১৪৮ জন উপস্থিত ছিলেন।

 

বর্ধিত সভার পর বিচারপতি সক্রিয় রাজনীতি থেকে অসুস্থতাজনিত কারণে নীরব রইলেন। বিএনপির চেয়ারম্যান তিনি রইলেন কিন্তু দলে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে মূলত খালেদা জিয়াই নেতৃত্ব দিতে থাকলেন। এরই মধ্যে সমমনা দল নিয়ে গঠিত হলো সাত দলীয় ঐক্যজোট। অন্যদিকে আগেই গঠিত হয়েছে আওয়ামী লীগসহ তাদের সমমনা ১৫ দলীয় ঐক্যজোট। বেগম খালেদা জিয়া দেশব্যাপী জনসংযোগে বের হলেন। ঘরোয়া রাজনীতির সুযোগে বেগম জিয়া ঢাকার বাইরে প্রথম সভা করেন খুলনায়। স্থানীয় ইউনাইটেড ক্লাবের দেয়ালের ভেতর এই সভাটি হয়। ঘরোয়া সভা হলেও এটি ধীরে ধীরে পাশের রাস্তা ছাড়িয়ে এক সমাবেশে পরিণত হয়। বেগম জিয়ার রজনৈতিক জীবনে যে অনন্য সাধারণ বিকাশ ঘটে খুলনার এ ঘরোয়া রাজনৈতিক সভা ছিল তাঁর আরেকটি ‘মাইলস্টোন’। এই সভায় আ.স.ম. মোস্তাফিজুর রহমান ছিলেন। এর পর ১৯৮৩ সালের ২৯ এপ্রিল তারিখে খুলনায় ঘুর্ণিঝড় উপদ্রুত এলকায় ত্রান কাজ চালাতে গেলেন তিনি। তার সাথে ছিলেন মীর্জা গোলাম হাফিজ ও মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি সেখানে দলের পক্ষ থেকে নগদ টাকাসহ ত্রাণসামগ্রী দান করেন। ১৯৮৩ সালের ৪ ও ৫ সেপ্টেম্বর সাতদলীয় ঐক্যজোট ও পনের দলীয় ঐক্যজোটের মধ্যে বৈঠক বসে। বৈঠকে এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ৫ দফা প্রণীত হয়। ৬ সেপ্টেম্বর ৫ দফা ঘোষিত হয়। এবার শুধু বিএনপির নেত্রীই নয়, সাত দলের নেত্রী হিসাবে আবিভূত হলেন বেগম খালেদা জিয়া। প্রথমেই তিনি বললেন, “অবৈধ এরশাদকে মানি না। তাঁকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। সামরিক শাসন বিরোধী গণতন্ত্রের আন্দোলনে স্পষ্ট ভূমিকা ও সাহসী বক্তব্যের জন্য তিনি অল্প কিছুদিনের মধ্যেই অধিষ্ঠিত হলেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের প্রধান নেত্রীর আসনে। এরই মধ্যে দু’জোটের আহ্বানে ৫ দফা দাবিতে সমরিক সরকারের বিরুদ্ধে ১৯৮৩ সালের ১ নভেম্বর প্রথম অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়। হরতালে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন বেগম খালেদা জিয়া। সফল হরতালের পর ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালিত হয়। গুলি, টিয়ারগ্যাস, লাঠিচার্জ এবং কাঁদানে গ্যাসে তিনি আহতও হন।

 

সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেই এভাবে সাহসী নেতৃত্ব দিলেন বেগম খালেদা জিয়া। প্রথমে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কয়েক মাস পর তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। একই সময়ে সাত দলীয় জোটের নেত্রী হিসাবে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৮৪ সালে আগস্ট মাসে বিএনপি চেয়ারম্যান নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বেগম খালেদা জিয়া ছাড়া আর কোন মনোনয়নপত্র জমা পড়েনি। ফলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সর্বসম্মত নেত্রী হিসাবে ১৯৮৪ সালের ১০ মে বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এই মুহূর্তগুলো ছিল বেগম খালেদা জিয়ার জন্য খুবই উল্লেখযোগ্য। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি একজন গৃহবধু থেকে তিনি রাজনীতিতে আসেন বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হয়ে। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে তিনি দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন এবং ১ এপ্রিল দলের বর্ধিত সভায় প্রথম ভাষন দেন। এরপর তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং ১৯৮৪ সালের ১০ মে নির্বাচিত হন দলের চেয়ারম্যান।

 

 

বিএনপিতে ভাঙ্গনের চেষ্টা

 

বেগম খালেদা জিয়া যখন বিএনিপির হাল ধরে, তখন সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন যেমন শুরু হয়েছে, তেমনি বিএনপির ভেতর শুরু হয়েছে, বড় ধরনের ভাঙন। এরশাদ ক্ষমতা দখল করে একের পর এক নেতাকে বিএনপি থেকে ভাগিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন। বাড়ি, গাড়ি, কোটি টাকার সম্পত্তির টোপ দিয়ে ঐসব সুবিধাবাদী নেতাদের দল ত্যাগে তিনি সমর্থ হন। বেগম জিয়া এরশাদের ওই কুকীর্তি ভালভাবেই উপলব্ধি করেন। ফলে খুব শক্ত হাতে তিনি বিএনপির হাল ধরেন। বিএনপির প্রথম ভাঙনের নেতৃত্ব দেন শাসসুল হুদা চৌধুরী ও প্রফেসর এম এ মতিন। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই তারা উপদলীয় কোন্দলে নিয়োজিত ছিলেন এবং স্বৈরাচারী সরকারের সাথে তাদের আঁতাত ছিল। বেগম খালেদা জিয়াকে দলের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনয়ন তাদের ক্ষুব্ধ করেছিল। এমন অবস্থার মধ্যে বিএনপি সংগঠিত হতে পেরেছিল। কিন্তু এ পরিস্থিতিতে হুদা-মতিনের উপদলীয় তৎপরতা  শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের ২৭ নভেম্বর কয়েকটি দলের সমন্বয়ে গঠিত এরশাদের জনদলে যোগদানের মাধ্যমে হুদা-মতিন প্রুপ বিলুপ্ত হয়। তারা পরবর্তীতে এরশাদের অবৈধ সরকারে যোগ দেন। এই অবস্থায় দলের হাল ধরে সামনে এগিয়ে যাওয়া খুব কঠিন ছিল। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া নিরাশ হলেন না। এগিয়ে গেলেন।

 

 

বিএনপির দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাঙ্গনেরও অবিচল বেগম খালেদা জিয়া

 

দলের দ্বিতীয় ভাঙনের সৃষ্টি করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান। ১৯৮৫ সালের ৬ এপ্রিল অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শাহ আজিজ গ্রুপ দলের ভাঙ্গন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করেন। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ৭ দল যখন ১৫ দলের সাথে যৌথভাবে বিরোধী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, ঠিক তখনই শাহ আজিজ গোপনে ক্ষমতাসীনদের সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময়  তথাকথিত জাতীয় ফ্রন্ট গঠনের কাজ শুরু হয়। অব্যাহত আন্দোলনের পরিপেক্ষিতে এরশাদ নির্বাচন স্থগিত করেন এবং রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করেন। খালেদা জিয়া অন্তরীন হন ১ মার্চ ৮৫। এর ফলে শাহ আজিজ খুব সুযোগ পেয়ে যান। একই সাথে ৭ দলীয় জোটেও ভাঙন ধরান এরশাদ। কাজী জাফর, সিরাজুল হোসেন খান, আনোয়ার জাহিদের সাথে ফ্রন্ট গঠনের উদ্যোগ নেন শাহ আজিজ। তার নেতৃত্বে  গোপনে কাজী জাফরের ইউপিপি, গণতানিত্রক পার্টি, মুসলিম লীগ (সিদ্দিকী), ক্ষমতাসীন জনদলের সমন্বয়ে ১৯৮৫ সালের ১৩ জুন ফ্রন্ট গঠিত ঘয়। কিন্তু এর খবর গোপন রাখা হয়। ওই দিকে বিএনিপতে আরও ভাঙন সৃষ্টি করে এবং খালেদা জিয়াকে বেকায়দায় ফেলার জন্য শাহ আজিজ তৎপরতা চালান।

 

এরই মধ্যে ঘটনাটি জানাজানি হয়ে গেলে পার্টির চেয়ারম্যান হিসাবে বেগম খালেদা জিয়া দলের স্ট্যান্ডিং কমিটি নতুন করে গঠন করেন। দলের নাম ভাঙিয়ে যাতে কেউ সরকারের সাথে দর কষাকষি করতে না পারে সে জনেই সাহসী উদ্যোগটি নেন খালেদা জিয়া। তিনি পার্টির নিয়ম শৃঙ্খলা ভঙ্গ করার অভিযোগে শাহ আজিজ, ব্যারিস্টার মওদুদ, এ.কে.এম মাইদুল ইসলাম, আব্দুল আলীম এবং ব্যারিস্টার সুলতান আহমদ চৌধুরীকে দল থেকে সাময়িকভাবে ২৫ জুন ‘৮৫ তারিখে বহিস্কার করেন। তাদের শোকজ করা হয়। কিন্তু তারা এর জবাব দেননি। তারা শাহ আজিজকে চেয়ারম্যান ও মাঈনুল ইসলামকে মহাসচিব করে পাল্টা বিএনপি গঠন করেন। এরই মধ্যে মন্ত্রিত্বের দর কষাকষি চলে। জাফর ইমাম, মওদুদ, সুলতান আহামদ চৌধুরী, মাইনুল ইসলাম এক এক করে এরশাদের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রিত্ব না পেয়ে শাহ আজিজ ফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে আসেন। ওইদিকে কাজী জাফর, সিরাজুল হোসেন খান, আতাউর রহমান খান সরকারে যোগ দেন।

 

এরপর শাহ আজিজ বিভিন্ন সময়ে বিএনপিতে যেতে চাইলেও বেগম খালেদা  জিয়ার পক্ষ থেকে কোন উৎসাহ দেখানো হয়নি। অবশেষে ১৯৮৮ সালের ১৭ জুলাই শাহ আজিজ তার নেতৃত্বাধীন বিএনপি বিলুপ্ত করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের প্রতি শর্তহীন সমর্থন ও আনুগত্য প্রকাশ করেন। ২৬ আগস্ট ৮৮ তাকে সদস্যপদ দেয়া হয়। একই বছরের ১ সেপ্টেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন। দলের তৃতীয় ভাঙন হয় মহাসচিব কে এম ওবায়দুর রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন আহমদ  ও ব্যারিস্টার আবুল হাসনাতের নেতৃত্বে। বেগম খালেদা জিয়া যেই জানাতে পারলেন, এর দল ভাঙার ষড়যন্ত্র করছে এবং এরশাদের সঙ্গে আঁতাতে লিপ্ত, তখনি তিনি ১৯৮৮ সালের ২১ জুন দলে চেয়ারম্যান হিসাবে দলের নির্বাহী ও স্থায়ী কমিটি বাতিল করেন এবং দলের মহাসচিব করেন ব্যারিস্টার সালাম তালুকদারকে। ফলে এরশাদের মন্ত্রিত্ব পাওয়ার আশা-আকঙ্খা ধুলিস্যাৎ হয়। অবশ্য আবুল হাসনাত শেষ পর্যায়ে এসে মন্ত্রিত্ব লাভ করেছিলেন।

 

একদিকে এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে নিরলস ও আপসহীন সংগ্রাম অন্যদিকে পার্টির বিরুদ্ধে পরিচালিত একের পর এক চক্রান্তের মোকাবিলা করে বেগম খালেদা জিয়া প্রমাণ করেছেন তিনি একজন বলিষ্ঠ নেত্রী প্রমাণ করেছেন তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা। পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির প্রকৃত বিকাশ ঘটেছে আসলে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বেই। খালেদা জিয়ার সাফল্য এখানেই যে, দলকে কেবল তিনি রক্ষাই করেননি, বরং আন্দোলনের প্রতিকূল পথ বেয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি প্রধানশক্তি হিসেবে।

 

বেগম খালেদা জিয়ার সাফল্য এখানেই যে, আপসহীন লোভশুন্য সংগ্রামের ধারায় তিনি এক বিশাল নবীন জেনারেশন গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। দেখা যায়, তার নেতৃত্বের ফলেই সারা বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল বিরোধী দল থাকা অবস্থায় একক ছাত্র সংগঠন হিসাবে প্রায় ৮০ ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন- বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে শক্ত ঘাঁটি হিসাবে আবির্ভূত হয়। খালেদা জিয়া বুঝে ছিলেন, দূরভবিষ্যতে বিজয় ছাড়া তার কিছু প্রর্থিত নেই। ৮৪-৮৬তে যখন অন্যান্য দল যাচ্ছে এরশাদের জালে, তখন বিএনপির প্রবীন নেতারা অনেকে বিভ্রন্ত। এ সময়েই যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন: ক্ষমতা চাইলে এখানে, ঠিক এখানে এসে হাজির হবে। কিন্তু ক্ষমতা নয়, সংগ্রাম।

 

 

৭ দলীয় ঐক্যজোট গঠন

 

বেগম খালেদা জিয়া যথার্থভাবেই অনুধাব করেন বিএনপির পক্ষে এককভাবে স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে লড়াই করা দূরহ। অন্য রাজনৈতিক দলগুলো আদর্শ কর্মসূচির অনুসরণে রাজনৈতিক জোট গঠন করেছে। বিএনপি রাজনৈতিক আদর্শ জনমতের সবচেয়ে অনুকুল হওয়া সত্ত্বেও এতদিন বিএনপির অভ্যন্তরীন দুর্বলতার কারণে অগ্রসর হতে পারছিল না। দেশপ্রেমিক, জাতীয়তাবদী তথা প্রগতিশীল আদর্শে বিশ্বাসী দলগুলোর সমন্বয়ে একটি রাজনৈতিক জোট করার বিষয়ে তিনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। অবশেষে অনেক আলাপ আলোচনা, সংলাপ সমালোচনা শেষে ৮৩ সালের আগস্ট মাসে ৭ দলীয় ঐক্যজোট আত্মপ্রকাশ করে।

জোটভুক্ত দলগুলো হলো:

(১)          বাংলাদেশ জাতীয়তাবদী দল (বিএনপি)

(২)          ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (ইউপিপি)

(৩)         জাতীয় লীগ

(৪)          জাতীয় গণতান্ত্রিক মুক্তি ইউনিয়ন (জাগমুই)

(৫)          ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (নুরুর রহমান)

(৬)         বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ  ও

(৭)          ডেমোক্রাটিক লীগ (রউফ)।

 

নিজস্ব শক্তি সঞ্চয়ের পর জাতীয় লক্ষ্য অর্জন, স্বৈরাচারীর পতন এবং গণতন্ত্রের বিজয় অর্জনের জন্য খালেদা জিয়া বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।  ৪ ও ৫ সেপ্টেম্বর ৮৩ সাত দলীয় ঐক্য জোট পনের দলীয় ঐক্য জোটের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সামরিক সরকারকে উৎখাত করে গণতান্ত্রিক সরকার কায়েমের লক্ষে যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ৫ দফা দাবি বিষয়ে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ৫ দফা দাবি তুলে ধরা হলো:

(ক)         অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করতে হবে এবং সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে।

(খ)          অবিলম্বের দেশে জনগণের সকল মৌলিক অধিকারসহ গণতান্ত্রিক পরিবেশ পুন:প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং রাজনৈতিক তৎপরতার উপর থেকে সকল বিধি নিষেধ প্রত্যাহার করতে হবে।

(গ)         নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকাররর তত্ত্বাবধানে দেশে অন্য যে কোন নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেই কেবল সার্বভৌম জাতীয় সংসদের নির্বাচ অনুষ্ঠান করতে হবে এবং সংবিধান সংক্রান্ত যেকোন

              সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতা কেবল জনগণের নির্বাচিত সার্বভৌম জাতীয় সংসদেরই থাকবে। অন্য কারো নয়।

(ঘ)        রাজনৈতিক কারণে আটক বিচারাধীন এবং সামরিক আইনে দন্ডিত রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে অবলম্বে মুক্তি দিতে হবে এবং সকল রজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।

             রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের হয়রানি ও গ্রেফতার বন্ধ করতে হবে।

(ঙ)         ১৯৮৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে সংগঠিত ছাত্র হত্যাসহ সামরিক শাসন বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এ যাবৎকাল ছাত্র শ্রমিক রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের হত্যার তদন্ত, বিচার ও দোষী

              ব্যক্তিদের শাস্তি, নিহত আহতদের তালিকা প্রকাশ ও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিক কর্মচারী, কৃষক-ক্ষেত মজুরসহ সকলের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

 

সংবাদ সম্মেলন উভয় জোটের পক্ষ থেকে ঐক্যবদ্ধ দুর্বার আন্দোলনের আহ্বান জানানো হয়। আন্দোলনকে যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যাবার পক্ষে একটি লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে বিএনপির  প্রতিনিধিত্ব করেন মেজর জেনারেল এম মজিদ উল হক (অব), ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল হালিম চৌধুরী, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, কোরবান আলী, আবদুল মান্নান প্রমুখ। ঘরোয়া রাজনীতির সুবাদে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী, শ্রমিক, পেশাজীবী এবং বুদ্ধিজীবী সকল পর্যায়ে বিভিন্ন আন্দোলনমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।

 

 

প্রথম সফল হরতাল

 

ইতোপূর্বে ছাত্র সমাজের ডাকে অর্ধ দিবস হরতাল পালিত হয়েছে। এবার রাজনৈতিক দল তথা সকল জোটের পক্ষ থেকে ১৯৮৩ সালের ১ নভেম্বর হরতাল আহ্বান করা হয়। এটাই এরশাদ বিরোধী সর্বাত্মক সফল হরতাল। স্বৈরাচারীর এজেন্ট ও তল্পিবাহকরা হরতাল বানাচালের চেষ্টা করে। বিভিন্ন জায়গায় বোমা নিক্ষেপ ও বাধা প্রদানের ঘটনা ঘটে। হরতাল শেষে বিকেলে পুরনো ঢাকার বিএনপি অফিসের সামনে এ জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় বিশেষ বিশেষত্ব হচ্ছে বিচারপতি সত্তারের বৈধ রাষ্ট্রপতির দাবি এবং মীর্জা গোলাম হাফিজের নিজেকে সাংবিধানিক স্পীকার দাবি। সকল রাজনৈতিক দল ও জোটের সমর্থনে হরতাল স্বত:স্ফুর্তভাবে সফল হয়। পরবর্তী রাজনৈতিক প্রবাহ এবং স্বৈরাচারী বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে এ হরতাল তাৎপর্যপূর্ণ ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।

 

নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে উভয় জোটের জনসভার কর্মসূচি পালিত হয়। বায়তুল মোকাররমের বিশাল জনসভায় খালেদা জিয়া বলেন ‘উস্কানি দিয়ে দেশ চালানো যায় না। আমরা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাস করি। ধ্বংসের রাজনীতিতে নয়।’

 

দুই জোট স্বৈরাচারী বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে আরও জোরদারকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল দুই জোটের কর্মসূচির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে এবং অন্যান্য পেশাজীবী সংগঠন আন্দোলনের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ঘোষণা করে।

 

 

সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি :  খালেদা জিয়া গৃহবন্দী

 

১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর উভয় জোট সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে। সরকার ১৪৪ ধারা জারী করে। পূর্ব নির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাতদলীয় জোট তোপখানা রোড এবং পনের দলীয় জোট জিরো পয়েন্টে অবস্থান নেয়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে হাজার হাজার মানুষ কর্মসূচিতে যোগাদান করে। দুপুরের দিকে পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সচিবালয়ের ভিতরেও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। হঠাৎ করেই রায়ট কার থেকে গরম রঙিন পানি ও টিয়ার গ্যাস অবস্থান ধর্মঘটকারীদের উপর নিজ্ষেপ করা হয়। পুলিশ ধর্মঘটকারীদের বেধড়ক পেটাতে শুরু করে। এক পর্যায় পুলিশ ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়। বিডিআর ও সেনাবাহিনী অবশেষে জনতার উপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে ১১ জন নিহত হয়। আহত হয় শাতাধিক। ছাত্র জনতা সচিবালয়লের দেয়াল ভেঙ্গে ফেলে। ক্রুদ্ধ জনতা ব্যাপক ভাঙচুর করে। জনতা সেগুনবাগানস্থ কাস্টমস অফিসে আগুন দেয়। সরকার বিকেল ৩ টায় সান্ধ্য আইন জারি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষিত ঘয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ব্যাপক  গ্রেফতারের শিকার হয়। সাতদলীয় জোট নেত্রী খালেদা জিয়া  ব্যক্তিগতভাবে এই সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দান করেন। নেতৃত্ব সম্পর্কে সাধারণ মানুষের যে হেয়ালী ধারণা অথবা নারী বলে নেতিবাচক ধারণা তার নেতৃত্ব অবস্থান ওই সব গতানুগতিক ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে।

 

বেগম খালেদা জিয়ার ইমেজ এবং নেতৃত্ব সরকারী বাহিনীর জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। পুলিশ ক্ষিপ্ত হয়ে খালেদা জিয়ার উপর সেল নিক্ষেপ করে। ওই সেল তার পায়ে পড়ে। তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। আহত অবস্থায়ও ছাত্র জনতার সাথে ছিলেন। এতে জনতা সাহসী হয়ে ওঠে। নিক্ষিপ্ত সেলে বিষক্রিয় দেখা দিলে তাঁকে ধরাধরি করে ফজলুল হক হলের অতিথি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। বিকালে হল প্রভোস্টের গাড়িতে তাকে বাসায় পৌঁছানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাঁকে বাসায় ঢুকতে দেয়া হয়নি। চিকিৎসার জন্য সিএমএইচ -এ গেলে তাঁকে চিকিৎসা না দিয়েই বাড়ি পাঠানো হয়। বাধ্য হয়ে তিনি এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ দিন রাতেই বেগম খালেদা জিয়া  ও শেখ হাসিনাকে এক মাসের আটকাদেশ দিয়ে স্ব স্ব বাসভবনে অন্তরীণ রাখা হয়। শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে মেজর জেনারেল মজিদ-উল-হক (অব), লে. কর্নেল এ এস এম  মোস্তাফিজুর রহমান (অব), ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ খান প্রমুখকে গ্রেফতার করা হয়।

 

১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বরের তান্ডবের প্রতিবাদে উভয় জোট ২৯ নভেম্বর ঢাকা এবং ৩০ নভেম্বর সারা দেশে হরতাল আহ্বান করে। ওই সময়ে সারা দেশে হত্যা নিপীড়ন নির্যাতনের ব্যাপক ঘটনা ঘটে। জনতা কয়েক জায়গায় অগ্নিসংযোগ করে। প্রেসিডেন্ট আবার স্বমূর্তি ধারণ করেন। শিথিল মার্শাল ল- কে শক্ত করেন। ঘরোয়া রাজনীতির নামে রাজনীতির যে আবহ শুরু হয়ে ছিল তা বাতিল করেন। পুনরায় পুরোদমে সামরিক আইন বলবেতের ঘোষণা দেন। আর প্রেসিডেন্ট আইউবের মত বলতে থাকেন এ দেশ প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের উপযোগী নয়। স্বৈরাচারীর নিপীড়ন দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বৃটিশ এম. পি পিটার শোর এরশাদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে চাপ প্রয়োগের দাবি জানিয়ে হাউজ অব কমন্স এ এক প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

 

 

খালেদা জিয়ার সাথে এরশাদের সাক্ষাৎ

 

আনোদলনের  উত্তাল অবস্থাকে দমন ও নিপীড়নের মাধ্যমে সমাধানে গেলেও ভবিষ্যত যে নিরাপদ নয়-সরকার তা বুঝতে পারে। খালেদা জিয়া যখন অন্তরীন, তখন অধস্তান জেনারেলদের পাঠিয়ে নরম গরম কথা বলাতেন। অফিসাররা খালেদা জিয়া  শুভান্যুধায়ী হিসেবে রাজনীতিতে আর না জড়োনোর অনুরোধ করেন। বিনিময় ‘যা চাবেন তাই পাবেন’- বলা হয়। প্রকারান্তরে ভীতি প্রদর্শন করা হয়: পরিণাম ভাল হবে না। কিন্তু খালেদা জিয়া ভীত বা প্রলোভন দুটোকেই সাহাসের সাথে জয় করেন। সরকারী আপস প্রসাত্ব প্রত্যাখ্যান করেন। দৃঢ়তার সাথে ঘোষিত ৫ দফার বাস্তাবায়ন দাবি করেন। এবাবে রাজী না হওয়ায় সামরিক জান্তার রোষানলে পড়েন তিনি। ব্যক্তিগত পর্যায়ে এতটা তিক্ততা সঞ্চয় করেন যে, বেগম খালেদা জিয়া-এরশাদের পতন না হওয়া পর্যন্ত অনড় অটল থাকেন।

 

 

সংলাপ তামাশা

 

জেনারেল এরশাদ ১৯৮৪ সালের ৭ জানুয়ারি তার সাথে সংলাপে বসার জন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানান। ৫৫টি রাজনৈতিক দলকে এ সংলাপে আমন্ত্রন জানানো হয়। এর অধিকাংশই প্যাড সর্বস্ব। কতিপয় সমর্থন শূন্য রাজনৈতিক নেতা তথা নামা সর্বস্ব জোট এরশাদের সংলাপে অংশগ্রহণ করে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ৭ দল, শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন ১৫ দল এবং জামায়াতে ইসলামী সংলাপে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। ফলে তার সংলাপ ব্যর্থ হয়। উভয় জোট এবং জামায়াতে ইসলামী প্রকাশ্য  রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা, প্রেস সন্সরশীপ এবং রাজনৈতিক নেতাদের কারারুদ্ধ রেখে এ ধরনের সংলাপকে অর্থহীন বলে অভহিত করে। সংলাপের কোন কার্যকারিতা না থাকায় জনগণের কাছে এটি একটি তামাশায় পরিণত হয়।

 

১৯৮৪ সালের ৬ জানুয়ারি জেনারেল এরশাদ রেডিও ও টিভিতে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সকলের প্রতি সহযোগিতার আহ্বান জানান। আবার ঘরোয়া রাজনীতি শুরুর ঘোষণা দেন তিনি।

 

 

উপজেলা বিরোধী আন্দোলন

 

কথিত প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের প্রস্তাবের আলোকে সকল থানাকে ক্রমান্বয়ে উপজেলায় উন্নিতকরণের পদক্ষেপ নেয়া হয়। বলা হয় তৃনমূল পর্যায়ে গণতন্ত্র এবং উন্নয়নকে পৌঁছে দেবার প্রচেষ্টা এটি। নিজের রাজনৈতিক ভিত্তিমূলকে হত্যাকরণের প্রয়াস বলে সকল রাজনৈতিক দল ও জোট এর বিরোধিতা করে। ২৯ জানুয়ারি ৮৪ এক বিবৃতিতে বেগম খালেদা জিয়া  সরকার ঘোষিত উপজেলা বয়কট করার লক্ষে জনমত গঠনের জন্য বিএনপির সকল শাখাকে নির্দেশ দেন। ৩০ জানুয়ারি ৮৪ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর আব্বাস আলী খান এক বিবৃতিতে সরকারকে উপজেলা নির্বাচন থেকে দুরে থাকার আহ্বান জানান। উপজেলা নির্বাচন নিয়ে সারাদেশে উত্তপ্ত পরিস্থিতিতের সৃষ্টি হয়। বার কয়েক নির্বাচন পিছিয়েও যখন উপজেলা নির্বাচন করা যায়নি তখন ১৮ মার্চ, ১৯৮৪ সরকার রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত উপজেলা নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করো হয়।

 

 

দ্বিতীয় দফা সংলাপ

 

১৯৮৪ সালের মার্চে সরকার আবার সংলাপের উদ্যোগ নেয়। জোটসমূহ সংলাপে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে চার দফা পূর্বশর্ত আরোপ করে। শর্তগুলো হলো: (১) অবাধ রাজনীতি, (২) সামরিক আইন প্রত্যাহার, (৩) রাজবন্দীদের মুক্তি, (৪) আলোচনার ভিত্তি হবে জোট ঘোষিত ৫ দফা।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী গ্রুপ এবং ছাত্রদের আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠায় সরকার এ সময় প্রকাশ্য রাজনীতির উপর থেকে বিধি নিষেধ প্রত্যাহার করে এবং সামরিক আইন প্রত্যাহারে আগ্রহ প্রকাশ করে। আলোচনার ভিত্তি হিসেবে ৫ দফাকে সরকার মেনে নেয়। সাত ও পনের দলীয় জোট এবং জামায়াতে ইসলামীর কাছে সরকার আমন্ত্রনপত্র পাঠায়। অন্যরা নমনীয়তা প্রদর্শন করলেও  বেগম খালেদা জিয়া পূর্বশর্ত দেন যে ৫ দফা না মানলে সংলাপে যাবেন না, সামরিক আইনের অধীনে  কোনো নির্বাচনে যাবেন না। ১৫ দলীয় জোট বন্ধী মুক্ত এবং মামলার বিষয়টি প্রাধান্য দেয়। এ সময় প্রধান নেতা আতাউর রহমান খান সরকার পক্ষে যোগদান করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। বিরোধী জোট ও রাজনৈতিক দলগুলোকে সামলানোর জন্য তাকে নেয়া হলেও তিনি বরং সরকারের বোঝা হয়ে দেখা দেন।  কার রাজনৈতিক দলসমূহ তার সাথে সংলাপে বসতে অস্বীকার করে। বিভিন্ন দল বিভিন্ন সময়ে সংলাপে অংশগ্রহণ করে। বেগম খালেদা জিয়া আতাউর রহমান খানের উপস্থিতিতে সংলাপে বসতে অস্বীকার করেন এবং সংলাপ কক্ষ ত্যাগ করেন। ৭ দলীয় জোটও পরে সংলাপে যোগ দেয়। খালেদা জিয়ার অনমনীয়তার এরশাদ ‘সর্বাগ্রে’ সংসদ নির্বাচন দিতে রাজী হন।

 

 

শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) আন্দোলন

 

১৯৮৪ সালের ২৫ এপ্রিল স্কপের সাথে তাদের  ঘোষিত দাবি দাওয়ার ব্যাপারে সরকার পক্ষের আলোচনা অুনষ্ঠিত হয়। সরকার তাদের ৫ দফার ব্যাপরে সুস্পষ্ট কোন ঘোষণা না দেয়ায় ব্যাপক হরতালের কর্মসূচী ঘোষণা করে। ঘোষিত ৪৮ ঘন্টার হরতালে জনজীবনে ভীতি সঞ্চরিত হয়। আতাউর রহমান খানের মধ্যস্থাতায় অবশেষে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সরকারের ভাষায় তাদের একটি বড় বিপদ কাটিয়া যায়’ (আতাউর রহমান খান, প্রধানমন্ত্রীর নয় মাস)।

 

 

দৈনিক দেশ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ

 

সরকার  জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বিএনপির মুখপত্র দৈনিক দেশ বন্ধ করে দেয়। কোন রকম কারণ ছাড়াই  সামরিক আইনে পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে বিএনিপকে কাবু করার কৌশল নেয়া হয়। দৈনিক দেশ এর প্রতি এরশাদ ব্যক্তিগতভাবে ক্ষিপ্ত ছিলেন। আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমানরা পার্বত্য চট্টগ্রামে ট্রেনিং নিচ্ছে-এ ধরনের খবরে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়েছে- এ অজুহাত দেখানো হয়। দেশ সম্পাদক পরবর্তীতে এরশাদের মন্ত্র নিযুক্ত হন। এতে প্রমাণিত হয় যে বিষয়টি একটি বোঝাপাড়ার বিষয় ছিল। এরশাদ আন্দোলন মোকাবেলার জন্য সব ধরনের ন্যাক্কারজনক পথ অনুসরণ করেছিল।

 

 

সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা

 

১২ জুলাই ১৯৮৪ প্রেসিডেন্ট এরশাদ ঘোষণা করেন যে, ৮ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সাত ও পনের দলীয় জোটসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সামরিক আইনের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তাব প্রত্যাখান করে। বিশেষ করে এরশাদ জনদলের অঘোষিত চেয়ারম্যান বিধায় এরশাদের অধীনে নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে না এ আশংকা ব্যক্ত করেন। সাত দলীয় জোট ২৫ জুলাই প্রতিরোধ দিবস পালন করে। এ দিন বায়তুল মোকাররমে আয়োজিত বিশাল জনসভায় বেগম খালেদা জিয়া সামরিক আইন প্রত্যাহারের জোর দাবি জানান। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন: সামরিক আইনের অধীনে নির্বাচনের যাওয়া সম্ভব নয়। ৩০ জুলাই বিএনপির পক্ষ থেকে নিযুক্ত লিয়াজোঁ কমিটির নেতা ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী এরশাদের মন্ত্রী নিযুক্ত হন। আন্দোলন মোকাবেলার জন্য এরশাদ যে অনৈতিক পথ অনুরসরণ করছিলেন আবারও তা প্রামানিত হয়। সেই রণকৌশলে এরশাদের সন্ত্রাসী: নতুন বাংলা   ছাত্র সমাজ অতর্কিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উপর হামলা চালায় । যৌথ প্রতিরোধে তারা পালিয়ে যায়।

 

১৯৮৪ সালের ৫ আগস্ট জিরো পয়েন্টে ৭ দলীয় জোটের এবং বায়তুল মোকাররমে ১৫ দলীয় জোটের জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় ২৭ আগস্ট অর্ধ দিবস হরতালসহ আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষিত হয়। জামায়াতে ইসলামী সাত ও পনের দলীয় জোটের কমৃসূচীর সাথে একাত্মতা ঘোষনা করে। ১৮ আগস্ট ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এক তরফাভাবে সরকারী খবর প্রচারের প্রতিবাদে রেডিও  ও টিভি ভবনের সমানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ২৭ আগস্ট পালিত হরতাল অবশেষে উভয় জোটের জনসভা শেষে ১৫ সেপ্টেম্বর এর মধ্যে দাবি মেনে নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। একই দিনে একই সময়ে অনুষ্ঠিত জামায়াতের জনসভা থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের আহ্বান জনানো হয়।

 

১৯৮৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সাত ও পনের দলীয় জোট ও জামায়াতে ইসলামীর পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচী অনুযায়ী যারা দেশে সকাল সন্ধা সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। হরতাল প্রতিহত করবার জন্য এরশাদ প্রাইভেট পেটোরা বাহিনী ব্যবহার করে। সারাদেশে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ দিনে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা কালীগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতা ময়েজ উদ্দীন হত্যা। হত্যাকারী আযম খানকে ঘটনার কয়েকদিন আগে এরশাদ জনসভায় তার ছোট ভাই বলে পরিচয় করিয়ে দেন। বেগম খালেদা জিয়া এ সব হত্যকান্ডের তীব্র নিন্দা করে হরতাল শেষে জনসভায় বলেন: জনগণের প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধা থাকলে বর্তমান সরকারের এই মুহূর্তে পদত্যাগ করা উচিত। পনের দল ও জামায়াতে ইসলামীর জনসভা থেকেই অনুরূপ দাবি ঘোষিত হয়।

 

এ দিকে নির্বাচন কমিশন ৩ অক্টোবর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণা করে। বিরোধীদল নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে। সরকারের তরফ থেকে এরশাদ সরকারকেই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার বলে অভিহিত করা হয়। 

 

অক্টোবরের ঢাকা অবরোধ আন্দোলন

১৯৮৪ সালের ১৪ আক্টোবর যৌথ গণতন্ত্রিক আন্দোলনের জন্য একটি মাইল ফলক। সাত দল, পনের দল এবং জামায়াতে ইসলামী এদিন ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে। ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ শ্লোগান নিয়ে প্রত্যন্ত এলাকা থেকেও লোকজন ঢাকা আসতে থাকে। স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে এটাই ছিল ওই সময়ে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ। সামরিক আইন প্রত্যাহার, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, মৌলিক অধিকার ও সুপ্রীম কোর্টের রীট অধিকার পুন:প্রতিষ্ঠাসহ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুন:প্রতিষ্ঠা, রাজবন্ধীদের মুক্তি ও দন্ডাদেশ বাতিলসহ সামরিক শাসন বিরোধী পাঁচ দফা দাবিতে সংগঠিত হয় এ আন্দোলন। জনগণ সড়ক পথ, রেল পথ ও নৌপথ ধরে আসার চেষ্টা করে। সরকার পদে পদে পথে পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। ঐ দিনি ঢাকা মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়।

 

বায়তুল মোকাররমে সাত দলীয় সমাবেশ, মানিক মিয়া এভিনিউকে পনের দলের সমাবেশ এবং শাপলা চত্বরে জামায়াতে ইসলামীর মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বায়তুল মোকাররমের মহাসমাবেশে সাত দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালদা জিয়া অগ্নিঝড়া বক্তব্য রাখেন। তার বক্তব্য জনতাকে নতুন আশায় নতুন ভরসায় এবং নতুন গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ার আকাংখায় উদ্বেলিত করে। প্রদত্ত ভাষনে তিনি বলেন: আর এক মুহূর্তের জন্যেও স্বৈরাচারী এরশাদাকে ক্ষমতায় রাখা যাবে না। ক্ষমতায় থাকার তার আর কোন অধিকার নাই। তিনি আরও বলেন, ব্যক্তি বিশেষের অভিশাপের জন্য সেনাবাহিনীর সুনাম বিনষ্ট হতে দেবো না। এ সভা থেকে ৮ ডিসেম্বর হরতাল এবং পর্যায়ক্রমে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষিত  হয়। পনের দল ও জামায়াতে ইসলামর জনসভা থেকেও অনুরূপ কর্মসূচি ঘেষিত হয়। সরকার কড়া সেন্সর আরোপ করে। সাংবাদিকরা ধর্মঘটে যায়। ফলে ওই দিন কোন সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়নি। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ঘোষিত নির্বাচন স্থগিত করা হয়।

 

১৯৮৪ সালের ৮ ডিসেম্বর সভা ও পনের দলীয় জোট এবং জামায়াতের ২৪ ঘন্টার হরতাল স্বত:স্ফুর্তভাবে পালিত হয়। অনুষ্ঠিত সব জনসভায় ২২, ২৩ ডিসেম্বর লাগাতার হরতালের কর্মসুচি ঘোষিত হয় স্কপও অনুরুপ কর্মসুচি ঘোষণা করে। পরবর্তীতে সফলভাবে লাগাতার হরতালের কারণে শাসকদল ভীত সন্ত্রসত হয়ে পড়ে। প্রেসিডেন্ট রেডিও ও টিভিতে ভাষণ দেন। ভাষনে ১৯৮৫ সালের প্রথমে সংসদ নির্বাচন, স্থগিত সংবিধানের আংশিক পুনর্জীবনের ঘোষণা দেন। পরে আরও কার্য ব্যবস্থা ঘোষিত হয়। বিরোধী দলসমূহ তাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখার জন্য ২২, ২৩ ডিসেম্বর হরতালের কর্মসুচি অপরিবর্তিত রাখে। 

 

 

দীর্ঘায়িত সংসদ নির্বাচন

 

১৯৮৫ সালের শুরুতেই সরকার নির্বাচনের পরিবেশ সৃস্টির জন্য কিছু ছাড় দেয়ার চিন্তা ভাবনা করে। বছরের প্রথম দিকে সরকারীদল ও আন্দেলনরত বিরোধী দলসমূহ বিবৃতি যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এ সময়ে ৫ দফা পূরণ না হলে নির্বাচনের না যাওয়ার বিষয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ চাপ সৃষ্টি করে। বছরের শুরুতে আইনজীবীদের আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে। বিরোধী দলের সম্মতি না নিয়ে সরকারী নির্দেশে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি নুরুল ইসলাম এক তরফা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। ঘোষণা অনুযায়ী ৬ এপ্রিল জাতীয় সংসদের নির্বাচন। আদেশের সাতে সঙ্গতি রেখে সংবিধানে সংশ্রিষ্ট ধার পুনর্ববাহাল কার হয়। সামরিক আদালত সমূহের বিলুপ্তি ঘটে। এরশাদ নতুন এক টেনোক্রাট মন্ত্রীসভা গঠন করেন। ৭ দলীয় জোট তথা যৌথভাবে আন্দোলনরত দলসমূহ নির্বাচনের পূর্বশর্ত হিসেবে পূর্বের মতই ঘোষিত ৫ দফার বাস্তবায়ন পুনঃব্যক্ত হয়। ১১  ফেব্রুয়ারি ইঞ্জিনিয়িার্স ইনস্টিটিউটে অনষ্ঠিত বর্ধিত সভায় বেগম খালেদা জিয়া এখনো অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি বলে মন্তব্য করেন। ৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের নির্বাচন স্থগিত করে নীল নক্সা অনুযায়ী তথাকথিত গণভোট ও উপজেলা নির্বাচন করা হয়। তবে আন্দোলন থেমে থাকেনি। ১৩  ফেব্রুয়ারি  ছাত্রনেতা রাইফুন বসুনিয়াকে  স্বৈরাচারীর এজেন্টরা হত্যা করে। ২১ মার্চ গণভোটের নামে প্রহসন অনুষ্ঠিত হয়। ১৬ মে ২৫৪টি উপজেলায় একই ধরণের ভোটারবিহীন নির্বাচন অনষ্ঠিত হয়।

 

১৯৮৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভায় বেগম খালেদা জিয়া অবাধ রাজনীতির সুযোগ দাবী করেন। এর উত্তরে এরশাদ ১ অক্টেবর ‘৮৫ থেকে ঘরোয়া রাজনীতি এবং ১৯৮৬ মার্চ/এপিলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাবনার কথা বলেন। ২২ নবেম্বর ‘৮৫ জাতীয়তাবদী ছাত্রদল, ছাত্রলীগ (লু-মা), জাগপা ছাত্রলীগ ইত্যাদি সংগটন সমন্বয়ে ‘সংগ্রামী ছাত্রজোট’ গঠিত হয়।

 

 

১৯৮৬ সালের বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ নির্বাচন

 

১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি দেশে চতুর্থবারের মত প্রকাশ্য রাজনীতি শুরু হয়। জোটসমূহ ৫ দফার বাস্তবায়নে দাবীতে ৩ ফেব্রুয়ারি হরতালসহ আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষিত হয়। ২৬ জানুয়ারি বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভায় দু’নেত্রীকে একই মঞ্চ থেকে আন্দোলন পরিচালনা আহবান জানানো হয়। নেত্রী একজন পরিপক্ক রাজনীতিবিদের মত দ্ব্যর্থহীন সম্মতি জ্ঞাপন করেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি বেগম খালেদা জিয়া বায়তুল মোকাররমের জনসভা থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের আহ্বান জানান। ২৮ ফেব্রুয়ারি এর মধ্যে দাবী না মানলে প্রত্যক্ষ কর্মসূচি  দেয়ার  ঘোষণা দেন। ফুলবাড়িয়ার জনসভা থেকে জামায়াতে ইসলামী একই দাবী তোলে। ২১ ফেব্রুয়ারি বেগম খালেদা জিয়া শহীদ  মিনার পাদদেশের সভায় ৫ দফার কোন আপস করা হবে না  বলে ঘোষণা করেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি ৭  এবং ১৫ দলের জনসভায় এই দাবী পুনর্ঘোষিত হয়। ১ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষনে এরশাদ ২৬ এপ্রিল জাতীয় সংসদ নির্বচানের তারিখ ঘোষণা করেন। ৮ মার্চ সাত, পনের ও জামায়াতে ইসলামীর আহ্বানে হরতাল পারিত হয়। ১৮ মার্চ চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে পনের দলীয় জোটের এক জনসভায় শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন ২২ তারিখের মনোনয়ন দাখিল যে কোন মূল্যৈ প্রতিহত করা হবে। তিনি আরও বলেন, যারা এই নির্বাচনে অংশ নেবে তারা জাতীয় বেঈমান হিসেবে চিহ্নিত হবেন।

 

১৯৮৬ সালের ২০ মার্চ এদিকে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উভয় নেত্রীসহ সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের যৌথ মিছিল করার কথা। দু’বিরোধী নেত্রী একবারও কাংখিত যৌথ মিছিলে অংশগ্রহণ করতে পারলেন না। বেগম খালেদা জিয়া  এসেও যৌথ মিছিলের নেতৃত্ব দেয়ার সম্মান পেলেন না। বিরোধীরা তারে মত করে মিছিল পরিচালনা করেন। ২১ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে এরশাদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে পুনরায় সকল রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধের হুমকি দেন। এরশাদের ভাষণের পরপরই  সাত দলীয় জোট, পনের দলীয় জোট এবং জামায়াতে ইসলামী পরবর্তী দিনের হরতাল কর্মসুচীসহ তাদের পরবর্তী কর্মসূচী প্রণয়েরন জন্য বৈঠকে বসেন। গভীর রাত পর্যন্ত এসব বৈঠক চলে। রাত ১.৪০ সাবাইকে হতবাক করে দিয়ে পনের দলীয় জোট নেত্রী  আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন যে তারা নর্বিাচনে যাবে। পনের দলীয় জোটের ঘোষণায় বলা হয় সরকার ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার চক্রান্ত করছে। তাদেরকে এ সুযোগ দেয়া যায় না। ওয়ার্কাস পার্টির মুখপাত্র সাপ্তাহিক নতুন কথায় এ সব ঘটনার মূল্যায়ন প্রশ্নে মন্তব্য করা যায় যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ, মিছিলে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতি, খালেদা জিয়াকে এড়িয়ে মিছিলের পট পরিবর্তন- কোথাও একটি  অভিন্ন যোগসুত্র রয়েছে।

 

২৪ মার্চ এরশাদের ক্ষমতা দখলের দিনটিকে স্বৈরাচারি প্রতিরোধ দিবস হিসেবেই পালন করে আসছে। বিএনপি ও সাত দলীয় জোট নেত্রী নির্বাচনে যাবার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করেন, পূর্বাপর ঘটনাবলী বিবৃত করেন এবং অবশেষে প্রশ্ন করেন: আজকে এমন কি অবস্থার সৃষ্টি হলো যাতে ৫ দফা বাস্তবায়িত না হতেই এবং জনগণের রক্তকে উপেক্ষা করে অবৈধ স্বৈরাচারী সরকারের হুমকীর ভয়ে ভীত হয়ে  কিংবা লোভ লালসার বশবর্তী হয়ে তাদেরকে জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে নির্বাচনে অংশ নিতে হচ্ছে?

 

১৯৮৬ সালের ২৪ মার্চ সামরিক শাসনের চার বছর পূর্তিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দেশব্যাপী কালোদিবস পালন করে। এ উপলক্ষে ডাকসু ভবেনের সামনে আয়োজিত সর্বস্তরের মানুষের সমাবেশে সভা ও পনের দলীয়  জোটকে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত  গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলা হয়: যৌথ সিদ্ধান্ত দানে ব্যর্থ হলে প্রয়োজনে ছাত্ররা জনগণকে সাথে রেখে স্বতন্ত্র ধারার রাজনীতি শুরু করবে।

 

১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ ঢাকা জেলা ক্রীড়া সমিতি মিলনায়তনে বিএনপির বর্ধিত সভায় বেগম খালেদা জিয়া সাজানো নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো হয় পরে সতা দলীয় জোটের বিবৃতিতে বলা  হয় নিরপেক্ষ নির্বাচনের ঘোষণা দেয়ার পরেও যে সরকার প্রধান বলেন নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে জিততেই হবে, আাপনারাই সরকার গঠন করবেন সেই সরকারের নিরপেক্ষতা বিষয়ক ঘোষণা একমাত্র মুর্খরা ছাড়া আর কেউ বিশ্বাস করবে না।

 

মে মাসের প্রথম দিকে বেগম খালেদা জিয়াকে অসম্মানজনকভাবে গ্রেফতার করা হয়। জনতা বেগম খালেদা জিয়া অন্তরীণের খবর শুনতে পেলে অসম্ভব কিছু হয়ে যেতে পারে। এজন্য তারা নাটকীয়তা ও ছল চাতুরীর আশ্রয় গ্রহণ করে।

 

 

উত্তাল আন্দোলন

 

ভোটারবিহীন তথাকথিত সংসদীয় নির্বাচন ‘৮৬ এর পরে এরশাদের স্বরূপ স্বমূলে উদঘাটিত হয়। নির্বাচনের পূর্ব যে আপেক্ষিক বিশ্বাসযেগ্যেতা ছিল এবং রাজনৈতিক দলসমূহ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে যে ভায়াবহ অভিজ্ঞাত অর্জন করে তা এরশাদের জনপ্রিয়তাকে হিমাঙ্কে পৌঁছে দেয়।

 

বছরটি শুরু হয় আইনজীবীদের সংবিধান বিরোধী দিবস পালনের মধ্য দিয়ে (৭ জানু’৮৭)। এ বছরের শুরুতেই বেগম খালেদা জিয়া তার সুবখ্যিাত ‘একদফা ’ দাবিতে রাজপথে নেমে আসেন।  স্বৈরাচারীর পতন না ঘঠিয়ে ঘরে ফিরবেন বা বলে যে সুদৃঢ় ঘোষণা দেন তা জনগণকে উদ্দীপ্ত করে। বছরটি ধরে বেগম খালেদা জিয়া কুৎসা রটনা থেকে হত্যার অপচেষ্টা সবকিছুই করা হয়। ৭ মার্চ জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বেগম খালেদা জিয়া বলেন: “ক্ষমতা চাইলে এখানে, ঠিক এখানে এসে হাজির হবে। কিন্তু ক্ষমতা নয় সংগ্রাম।’ এ সময়ে ছাত্রদলের উপর অপরিসীম নির্যাতন নেমে আসে। ছাত্রদরের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর হক বাবলুকে মোহসীন হলে পরিকল্পিতভাবে সরকারের লোকেরা হত্যা করেছে বলে ছাত্রদল অভিযোগ করে।

 

বিভিন্ন উপলক্ষে বুদ্ধিজীবীরা বিবৃতি এবং নানাবিধ কার্যক্রেমের মাধ্যমে আন্দোলনেক ত্বরান্বিত করেন। জেলা পরিষদে সেনা সদস্যদের ঢুকিয়ে দিয়ে সমাজকে সাময়িকীকরণের চেষ্টা করেন। এর প্রতিবাদে সাত, আ্ট ও পাঁচ দলীয় জোট এবং জামায়াতে ইসলামীর আহ্বানে হরতাল পালিত হয়। সমগ্র দেশে আন্দোরন তুঙ্গে পৌঁছে।

 

জোটসমূহ ১৯৮৭ সালের ২২-২৫ জুলাই একটানা ৫৪ ঘন্টার হরতার আহ্বান করে। ২১ জুলাই বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের চেষ্টা করা হয়। তিনি কৌশলে সাহসিকতার সাথে রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন এবং পরের দিনের কর্মসূচিতে যোগদান করেন।

 

২৮ অক্টোবর দেশের দুই শীর্ষ নেত্রী-বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা যৌথ বৈঠকে মিলিত হন। এ বৈঠকের মাধ্যমে আপামর জনসাধারনের অনেক দিনে চাওয়ার বাস্তবায়ন ঘটলো। বেঠকে তারা সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ভবিষ্যতে করণীয় সম্পর্কে মত বিনিময় করেন। বৈঠক শেষে দুই নেত্রীর যৌথ ঘোষণায় বলা হয়: ‘স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের লক্ষ্যে ১-১০ নভেম্বর সফল কর্মসূচী ঐক্যবদ্ধভাবে আমরা সফল করবো। দেশে গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠার মুক্তি যুদ্ধের চেতনাকে পূর্ণ প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের লক্ষ্য। দলমত নির্বিশেষে সকল গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এরশাদ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন এগিয়ে নেবার আহ্বান জানাচ্ছি।’

 

রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘৮৬ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছিল বেগম খালেদা জিয়া রাজনৈতিক উদরতায় তা বিদূরিত হয়ে ‘৮৭ সালে তা কার্যকর ঐক্যের রূপ পরিগ্রহ করে।

 

 

আপসহীন নেত্রী

 

গৃহবধু এবং রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ বলে কথিত বেগম খালেদা জিয়া হিংসা প্রতিহিংসা জটিলতা কুটিলতা হত্যা ষড়যন্ত্র নিপীড়ন নির্যাতনকে উপেক্ষা করে প্রাথমিক সময়গুলো অতিক্রম করেন। যা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলে ছিল অভাবনীয়। প্রতিকূল পরিবেশে নিজ বুদ্ধিমত্তা সাহস ও দৃঢ়তা দ্বারা তিনি অনুকূলে নিয়ে আসেন। ১৯৮৭ সালেই তিনি জনতার মন জয় করে বরিত হন আপসহীন নেত্রী অভিধায়। তিনি যেমন জাতীয়তাবাদী শক্তি তথা জাতীয়তাবাদী দলকে সংগঠিত করেছেন দলও কতিপয় বিশ্বাসঘাতক বাদে সমস্ত পর্যায়ে সময় শ্রম অর্থ ত্যাগ তিতিক্ষা দিয়ে একজন বেগম খালেদা জিয়া আপসহীন নেত্রীকে নির্মাণ করেছে। তার নিজের উদ্যম  উদ্যোগ অপরিসীমপরিশ্রম ক্ষমতা তার জনতার সহযেগিতা সহমর্মিতায় তিনি শুধু দলের নন হয়ে উঠেছেন কোটি কোটি মানুষের মহিয়সী নেত্রী-দেশনেত্রী। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রান্তসীমায়ই উদ্ভব লালন বিকাশ ঘটে-একজন ভবিষ্যত রাষ্ট্রনায়কের। ওই সময়  ঘটনা প্রবাহ নিয়ন্ত্রিত হয়েছে বেগম খালেদা জিয়াকে কেন্দ্র করেই। সেই যে পাদ প্রদীপে আস-সেই যে কেন্দ্র বিন্দুতে পৌঁছে-সেখান থেকে পিছু হটতে হয়নি কখনও আর। বিশ্বের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে তার দৃঢ়তা দেশপ্রেমের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছে।

 

 

ভোটারবিহীন দ্বিতীয়বার সংসদ নির্বাচন

 

‘৮৬ এর ভোটারবিহীন অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির অংশগ্রহন না থাকায় তা আন্তর্জাকিভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। এমনিতেই সাজোনো নির্বাচন এরশাদের জন্য বুমেরাঙ হয়ে দাঁড়ায়। আর একটি  গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করে বৈধতা নেযার প্রয়াস পান। ১৯৮৮ সালের ১ জানুয়ারি সরকার ঘোষণা করে যে ২৮ ফেব্রুয়ারি আবার জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ দিন টিএসসি মিলনায়তনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে বেগম খালেদা জিয়া সরকারের বিশ্বাস যোগ্যতার প্রশ্ন তোলেন এবং দৃঢ়তার সাথে ‘একদফার’ ঘোষণা দেন। আট দলীয় জোট নির্বাচনের ঘোষণা প্রত্যাখান করে। জামায়াতে ইসলামী ঘোষণা করে তারা নির্বাচনে যাবে না। তিনি জোটের লিয়াজোঁ কিমিটি নির্বাচন ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ জানায়। এদিকে ২২টি ছাত্র সংগঠন ঘোষণা দেয় নির্বাচনকে তারা সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে প্রতিহত করবে। ১২ জানুয়ারি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দেশব্যাপী জনসংযোগ শুরু করেন। এসব সভায় তিনি এক দফায় অনড় থাকেন।

 

নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত যৌক্তিক হয়ে ওঠে তখনই  যখন দেখা যায় জাতীয় পর্টি তিন চতুর্থাংশ আসন লাভ করে। নামগন্ধহীন প্যাড র্স্ববৃস্ব ৭১ দলের সমন্বয়ে গঠিত সম্মিলিত বিরোধী মোর্চা (কপ) পেয়েছে ১৮ আসন। ২৪ মার্চ তিন জোট, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য বিরেধীদল পূর্বঘেষিত কালো দিবস উপলক্ষে সমাবেশ বিক্ষোভ মিছিল করে। ২৫ এপ্রিল তিন জোট ও দলসমূহ হরতার পালন করে।

 

এসব হরতাল মিটিং মিছিলে এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম প্রচারণার তীব্র প্রতিবাদ করে হরতাল পালন করেন। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় সমাবেশে দেশনেত্রী জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার কায়েম করে মুক্তিযুদ্ধের চেতান বাস্তবায়নের আহ্বান জানান।

 

 

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচনের দাবি

 

১৯৮৮ সাল বন্যা বিতর্কিত নির্বাচন আন্দোলন লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হন। জোটসমূহ এবং রাজনৈতিকদলসমূহ আন্দোলনকে চাঙ্গা করার সিদ্ধান্ত নেয়।এ সময় বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টায় ঢাকায় আসেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এশিয় বিষয়ক সাব কমিটির চেয়াম্যান স্টিফেন সোলার্জ। বেগম খালেদা জিয়া সোলার্জকে পরিষ্কার করে জানিয়ে দেন যে এরশাদের অধীনে কোনো নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না। সুতরাং এরশাদের অধীনে কোন নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে না। উল্লেখ্য যে, বিএনপি আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এরশাদ পতনের একদফা আন্দোলনকে বেগবান করে এরশাদকে পদত্যাগে বাধ্য করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ ও তত্ত্বাধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে। স্বৈরশাসক সামরিক শাসন, জোরপূর্বক ক্ষমতা দখলকারী এরশাদের সাথে কোন আপস নেই ১৯৮৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শামসুন নাহার হলের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে বেগম খালেদা জিয়া পুরোল্লেখিত বিষয় পুনরোক্তি করেন।

 

৮ ও ৯ মার্চ ‘৮৯ ইঞ্জিনিয়িার্স ইনস্টিটিউটে বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় অধিবেশেনের উদ্বোধনী ভাষণে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেন: বিএনপি কারো কাছে মাথা নত করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না।

 

সরকার বিরোধী আন্দোলন যখন বিভক্তির বেড়াজালে বিড়ম্বিত তখন সুপ্রিম কোর্টে হাইকোর্টের বিভক্তি অর্থাৎ বিভিন্ন আঞ্চলিক শহরে প্রতিস্থাপনের আদেশ বাতিলপূর্বক এক যুগান্তকারী ও সাহসী রায় প্রদান করে। এরশাদ প্রথম বারের মত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। বিরোধী শক্তি প্রবল নৈতিক শক্তি লাভ করে। এদিকে ২৭ নভেম্বরর ‘৮৯ শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের আহুত হরতাল উত্তাপ সঞ্জার করে। স্কাপ আন্দোলানকে আরও জোরদার করার প্রয়াসী হয়। এ সময় আর একটি ঘটনা ঘটে । ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে একীভুত না করার কারণে বেগবান হতে পারেনি।

 

 

খালেদা জিয়ার একটানা অনশন

 

১৯৮৯ সালের ১ নভেম্বর জাতীয়তাবাদী দল তথা ৭ দলীয় জোটের ২৭ জন নেতাকর্মী নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচনের দাবিতে গুলিস্তান চত্বরে একটানা ১০ ঘন্টা প্রতীক অনশন পান করেন। সাত দলীয় জোটের অনশনে সংহতি প্রকাশ করার জন্য বিভিন্ন রজনেতিক দলের বিপূর সংখ্যক নেতাকর্মী গুলিস্তান চত্বরে আসেন। এসময় বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বেগম খালেদা জিয়াকে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক বলে অবহিত করেন।

 

 

মওলানা ভাষানীর মাজারে

 

১৯৮৯ সালের ১৭ নভেম্বর বেগম খালেদা জিয়া মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর মুত্যুবার্ষিকীতে গভীর শোক প্রকাশ করেন। তিনি দেশের ভূখা-নাঙ্গা অসহায় মানুষে অধিকার প্রতিষ্ঠার মজলুম জননেতার মত সংগ্রামের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন: আমরা কিছু পাবার বা নেবার জন্য আন্দোলন করছি না, দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং সাধারণ মানুষের কল্যানের জন্য রাজনীতি করছি। এদিকে ২৯-৩০ নভেম্বর দুদিন এক দফার দাবীতে ৭ দলীয় জোট হরতার পালন করে। ‘৮৯ সারা সময়ই  রাজপথে  থেকেছেন খালেদা জিয়া। জনগণকে এক দফার আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হবার জন্য উৎস প্রনান্তকর চেষ্টা করেছেন।

 

 

গণঅভ্যুত্থান ও বেগম খালেদা জিয়া

 

শহীদ জিয়ার শাহাদতের ঘা মুছতে না মুছতেই বিএনকি তছনছ করে দেয় আর একটি  বিপর্যয়। সেনা প্রধান লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ষড়যন্ত্রের অনেক বাঁক অতিক্রম করে অবশেষে একটি সাংবিধানিক সরকারকে ‘শুধুমাত্র ক্ষমতার জোরে শুধুমাত্র অস্ত্রের জোরে’ পদচ্যুত করেন। যার করুনা আশীর্বাদ আনুকূল্য তাঁকে অবাঞ্ছিত অবস্থা থেকে একটি বাঞ্ছিত অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে তার আদর্শ ভাবনীতি নৈতিকতা তার উত্তরাধিকার কোন কিছুই তাকে নিবৃত করতে পারেনি। যখন তার উত্তরসূরী সহধর্মিনী তার আদর্শ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পরিপূর্ণতার জন্য অগ্রসর হয়েছেন তখনও বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ মমত্ববোধ পোষণ না করে পথে পথে কন্টক বিছানোর দুষ্কর্মটি করেছেন। শাহাদাতের পরে স্বার্থ সুবিধা এবং ক্ষমতা লিপ্সা যখন অনেক লোককে অন্ধ করে ফেলে তখন শহীদ জিয়ার জীবনাদর্শ নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন তাঁর জীবন সাথী বেগম খালেদা জিয়া।

 

প্রায় ৯ বছর দীর্ঘ ওই সংগ্রামের ইতিহাস বড়ই কঠিন নির্মম। কোরাজন একিনো- বেগম খালেদা জিয়ার মতো যাঁকে উত্তরাধিকার অর্জনের জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়েছে কিন্তু অপেক্ষার এতো দীর্ঘ রাত্রি তাঁকে অতিক্রম করতে হয়নি। ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৯ বছরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে এ নিবন্ধে। শুরুতেই এটা  স্পষ্ট হয়েছে যে, ‘বন্দুকের নল দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা বেড়িয়ে এসেছ’জনমনে তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে মাত্র ছ’মাসের মধ্যেই। ১৯৮২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসকে কেন্দ্র করে যার সূচনা ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর স্বৈরাচারীর পতনের মধ্যদিয়ে তার সমাপ্তি। নানা চড়াই উৎড়াই বিশ্বাস এবং বিশ্বাসঘাতকাতার মধ্যদিয়ে এগিয়ে গেছে গণতন্ত্রিক সংগ্রাম। আমরা দেখেছি প্রায় ৯ বছরের ইতিহাস। সব ঘটনা উল্লেখ সম্ভবও নয়। প্রযোজ্য নয়। তবে জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি আন্দোলনও  প্রতিটি প্রত্যয় ব্যক্ত করার সীমিত প্রয়াস এতে বিধৃত।

 

এখন ৯০ বিজয়ের মূল লক্ষ্যের দিকে ধাবমান তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাবলীর দিনপঞ্জির দিকে অগ্রসর হব:

নব্বই এর নববর্ষে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার শুভেচ্ছা দিয়ে শুরু হয় নবযাত্রা। শুভেচ্ছা বাণীতে তিনি বলেন:

স্বৈরাচারী বিরেধী গণআন্দোলনকে শানিত করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আমরা বরণ করছি ইংরেজি ১৯৯০ সালকে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয় ও নৈরাজ্যকর অবস্থা আজ জাতিকে গ্রাস করতে বসেছে। সকল শ্রেণী ও পেশার জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে গণআন্দোলনকে দুর্বার বেগবান করে এই স্বৈরাচারী সরকারকে বাধ্য করে একটি  নির্দলীয় নিরপেক্ষ ও তত্তাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে জনপ্রনিধিত্বিশীল সরকার প্রতিষ্ঠা মাধ্যমে গণতন্ত্র ন্যায় বিচার, সুষমবন্টন ভিত্তিক অর্থনীতি শোষণমুক্ত সমাজ কায়েম করতে হবে-এটাই হোক আমাদের নববর্ষের শপথ। শহীদের রক্ত বৃথা যাবে না। জনতার বিজয় অবশ্যম্ভাবী।

০৪ জানুয়ারি ’৯০

:  সাত, পাঁচ দলীয় জোট এবং অন্যান দলের জতীয় সংসদ অভিমুখ যাত্রা

:  পুলিশী নির্যাতন ও লাঠিচার্যের প্রতিবাদে খালেদা জিয়াসহ অপরপর নেতৃবৃন্দের ফার্মগেটে রাজপথে অবস্থান ধর্মঘট।

 

২৪ জানুয়ারি ’৯০

: গণঅভ্যুত্থান দিবসে খালেদা জিয়া গুলিস্তানের জনসভায় এক দফার পুনরাবৃত্ত।

 

৯ জানুয়ারি ’৯০  

: নেত্রকোনা বিএনপি আয়োজিত সভায় খালেদা জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র হত্যা করেছে সোনার বাংলা নাম নিয়ে আর জাতীয় পার্টি করেছে নতুন বাংলা নাম নিয়ে।

 

১৭ জানুয়ারি ’৯০                

: উপজেলা নির্বাচন-দ্বিতীয় পর্যায় প্রতিহত করণের প্রচেষ্টা।

 

২১ জানুয়ারি ’৯০

: শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদনের পথে খালেদা জিয়াকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষন। খালেদা জিয়ার উক্তি: হত্যা করে অথবা হত্যার ভয় দেখিয়ে আন্দোলন থেকে সরানো যাবে না।

 

২২ জানুয়ারি ’৯০ 

: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মান্নানের স্বৈরাচারীর সঙ্গে সম্পৃক্তকতা এবং নিরপেক্ষতা হারানোর অভিযোগ।

 

২৬ জানুয়ারি ’৯০               

:  মুক্তিযুদ্ধে শহীদ জিয়ার অবদান স্মরণ। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনের আহ্বান।

 

২৮ জানুয়ারি ’৯০               

: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রদলের নিরঙ্কুশ জয়লাভ। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুরুপ ফলাফল।

 

৩১ মার্চ ’৯০        

: আমান উল্লাহ আমান ছাত্রদলে আহ্বায়ক নিযুক্ত।

 

০৬ জুন ’৯০         

: ডাকসু নির্বাচনের ছাত্রদলে  ‘আমান-খোকন-আলম’ এর নিরঙ্কুশ জয়লাভ।

 

২৭ জুন ’৯০           

: বিএনপির দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে অর্থনৈতিক দূরবস্তার জন্য খালেদা জিয়া ওয়ান ম্যান শো’কে দায়ী করেন।

 

২৫ আগস্ট ’৯০    

: ডাকসু ঘোষিত স্বৈরাচার বিরোধী বিক্ষোভ মিছিল আমানসহ ছাত্রনেতাদের পুলিশের বেধড়ক পিটুনি।

 

২৩ সেপ্টেম্বর ’৯০               

: সরকারী প্রত্যক্ষ মদদে চট্টগ্রাম ছাত্রদল নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন মিঠুর মৃত্যু।

 

২৯ সেপ্টেম্বর ’৯০                

: ডাকসুর সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা।

 

০১ অক্টোবর ’৯০

: সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ছাত্র কনভেনশন। উল্লেখ্য ছাত্রদল এ সময় বিপুল বিজয় অর্জন করে। কনভেনশনে প্রকারান্তরে এক দফার পক্ষে ঘোষিত দাবীনামা গৃহিত হয়। আন্দোলন ক্ষেত্রে এটি মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায়।

 

১০ অক্টোবর ’৯০

: বায়তুল মোকাররমের সমাবেশে খালেদা জিয়ার ভাষণ মুহূর্তে পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জ। লাঠিচার্জে খালেদা জিয়াসহ নেতৃবৃন্দ আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে যান। পুলিশ গুলি করে। জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ করে। ছাত্র নেতা জেহাদ নিহত হয়। ক্লান্ত খালেদা জিয়া জেহাদের লাশ দেখার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যম্পাসে ছুটে আসেন।

 

 

জেহাদের লাশ সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য

 

জেহাদের লাশ ক্যাম্পাসে নিয়ে আসলে সাধারণ ছাত্ররা আবেগপূর্ণ হয়ে ওঠে। ছাত্রদের অনৈক্যের কারণেই আন্দোলন সফল হচ্ছে না বলেই সাধারণ ছাত্রদের ধারণা। কোন রকম আলোচনা বা প্রস্তাবনা ছাড়াই সাধারণ ছাত্রদের কণ্ঠে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ধ্বনি শোনা যায়। জেহাদের লাশকে সমানে রেখে প্রকৃত প্রস্তাবেই সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য গঠিত হয়। সর্বমোট ২৩ সংগঠন জেহাদের লাশকে সামনের রেখে শপথ বাক্য উচ্চারণ করে। ডাকসুর নেতৃত্ব গঠিত এই সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যেই স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের মূল নিয়ামক শক্তির কাজ করে।

 

১২ অক্টোবর ’৯০ 

: সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের আহ্বানে অর্ধদিবস হরতাল পালিত। ছাত্র মিছিলে নজিরবিহীন নির্যাতন। আমানসহ ছাত্র নেতৃবৃন্দ গুরুতর আহত।

 

১২ অক্টোবর ’৯০ 

: পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে প্রেসক্লাবের সামনে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের প্রতিবাদ সমাবেশ।

 

১৩ অক্টোবর ’৯০               

:সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য আহুত দেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘট।

 

 

পলিটেকনিকে তান্ডব

 

ছাত্র ঘর্মঘট চলাকালে পলিটেকনিকে পুলিশি নির্যাতনের বিরল নজির হয়ে দাঁড়ায়। ছাত্র, শিক্ষক, অধ্যক্ষ সবাইকে অপমান অপদস্ত করে। এ সময় পলিটেকনিক ছাত্র মুনিরুজ্জামান মুনির মাথায় গুলি লাগে। দ্রুত হাসপাতালে নিলে ডাক্তার তাকে মৃত বলে ঘোষণা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে লাশ নিয়ে এলে জাতীয় নেতৃবৃন্দ একাত্মতা প্রকাশ করেন। বিকালে লাশ নিয়ে মিছিল বেরুলে পুলিশ হামালা করে। ছাত্ররা শাহবাগ পুলিশ কন্ট্রোল রুমে আগুন লাগিয়ে দেয়।

 

 

জেহাদের গ্রামের বাড়িতে খালেদা জিয়া

 

এদিন দেশনেত্রী খালেদা জিয়া সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় নবগ্রামে জেহাদের গ্রামের বাড়িতে যান। তার পরিবারকে সান্তনা দেন। উল্লাপাড়ায় খালেদা জিয়ার আগমনে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। এলাকায় শোকের ছায়া  নেমে আসে।

 

 

বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা অকার্যকর

 

সরকার ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ভীত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠন বন্ধ ঘোষণা করেন। তবে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ভিসিকে ঘেরাও করে। সিন্ডিকেট জরুরী সভায় সরকারি আদেশকে ৭৩-এর অধ্যাদেশ পরিপন্থী এবং অভিপ্রেত বলে অভিহিত করে।

 

১৪ অক্টোবর ’৯০

: মুনির হত্যার প্রতিবাদে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের দেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘট।

: গুলিস্তানে অনুষ্ঠিত জনসভায় যে কোন মূল্যে অর্জিত ঐক্য ধরে রাখার আহ্বান।

: সারাদেশে ছাত্র ধর্মঘট আন্দোলন। রাজশাহীতে চরম উত্তেজনা।

 

১৫ অক্টোবর ’৯০

: ছাত্র হত্যা ও পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে তিন জোট ও জামায়াতে ইসলামীর অর্ধ দিবস হরতাল পালন। পুলিশি নির্যাতন। ভাঙ্গুরা, ময়মনসিংহে ট্রেনে অগ্নিসংযোগ।

: খালেদা জিয়া  ঐক্যের প্রশ্নে বলেন কোন শ্লোগানের ঐক্য নয়। এই ঐক্য ছাত্র যুবক জনতার রক্তে গড়ে উঠেছে। কোন শ্লোগান বা বিভ্রান্তিতে ঐক্যে ফাটল ধরবে না।

 

১৬ অক্টোবর ’৯০               

:  জোট ও বিরোধী দলসমূহ আহুত অর্ধ দিবস হরতাল স্বত:স্ফুর্তভাবে পালিত।

 

১৭ অক্টোবর ’৯০ 

: শিক্ষা প্রতিষ্ঠনসমূহে (শান্তি শৃংখলা) অধ্যাদেশ-৯০ দাবি করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের পায়তারা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধে ব্যর্থ।

 

১৮ অক্টোবর ’৯০               

: সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার দাবিতে প্রেসক্লাব সম্মুখে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যর সমাবেশ।

 

১৯ অক্টোবর ’৯০

: তিন জোট ও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের আহ্বানে সারাদেশে শোক দিবস পালিত।

 

২০ অক্টোবর ’৯০

: রাজশাহীসহ সর্বত্র আঞ্চলিক সমাবেশ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় মৌন মিছিল।

 

২১ অক্টোবর ’৯০ 

: বিভিন্ন জোট ও দলের আহ্বানে বিক্ষোভ দিবস পালিত।

 

২২ অক্টোবর ’৯০

: সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের উদ্যোগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্র শিক্ষক অভিভাবক সমাবেশ অনুষ্ঠিত।

 

২৩ অক্টোবর ’৯০

: জোট ও রাজনৈতিক দলসমূহ আহুত জেলা-উপজেলা ঘেরাও আন্দোলন। তিন শতাধিক আহত।

 

২৪ অক্টোবর ’৯০ 

: সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যর আহ্বানে ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল ও প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ।

 

২৫ অক্টোবর ’৯০

: বন্ধ ঘোষিত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার দাবীতে ছাত্র ঐক্যের সমাবেশ।

 

২৬ অক্টোবর ’৯০

: সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের পর্যালোচনা সভা।

 

২৭ অক্টোবর ’৯০ 

: পূর্বঘোষিত কর্মসূচী অনুযায়ী রাজপথ, রেলপথ, পানিপথ অবরোধ কর্মসূচী পালিত।

: অবরোধ চলাকালে রাজপথে খালেদা জিয়ার উপস্থিতি।

: গুলিস্তান চত্বরে খালেদা জিয়ার ভাষণ। সরকারের কথায় আর দেশ চলছে না বলে মন্তব্য।

 

২৮ অক্টোবর ’৯০               

: দেশব্যাপী প্রতিরোধ দিবস পালিত।

 

২৯ অক্টোবর ’৯০

: স্কুল খোলা দিনে ক্লাস বর্জন করার কর্মসূচী ঘোষণা।

 

৩০ অক্টোবর ’৯০               

: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন কর্তৃক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ বাতিলের দাবি (সভা ও সমাবেশ)।

 

৩১ অক্টোবর ’৯০               

: বাবরী মসজিদ ভাঙার ঘটনা যাতে অন্য খাতে প্রবাহের চেষ্টা করা না হয় সে জন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে অবস্থান গ্রহণ।

 

০১ নভেম্বর ’৯০  

: সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার চেষ্টা।

 

০২ নভেম্বর ’৯০  

: সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার চেষ্ট অব্যাহত।

 

০৩ নভেম্বর ’৯০ 

: সাম্প্রাদায়িক দাঙ্গা দমনের নামে ১৪৪ ধারা ও সান্ধ্য আইন জারি।

 

০৪ নভেম্বর ’৯০  

: সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের মিছিল। পুলিশি নির্যাতন।

 

০৫ নভেম্বর ’৯০  

: বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের দাবীতে ৭ দলীয় ঐক্যজোট কর্তৃক টিভি ভবন ঘেরাও।

 

০৬ নভেম্বর ’৯০ 

: ‘এক দফা এক দাবি’ বাস্তবায়নের দাবীতে রাজধানীর বাংলা মোটরে ৭ দলীয় জোটের বিশাল জনসভা।

 

০৭ নভেম্বর ’৯০  

: বিএনপির তথা ৭ দলীয় জোটের বিপ্লব ও সংহতি দিবস পালন।

: দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য ৭ নভেম্বের চেতনায় সকল পক্ষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান।

 

৮  নভেম্বর ’৯০  

: বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল প্রতিষ্ঠান না খুলে রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ে তালা ঝুলবে-এ আহবান নিয়ে রাষ্ট্রপতির সচিবালয় মুখে মিছিল।

 

৯ নভেম্বর ’৯০

: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাথে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের বৈঠক।

 

১০ নভেম্বর ’৯০

: স্বৈরাচারের পদত্যাগের দাবীতে তিন জোট, অন্যান্য রাজনৈতিক দল, পেশাজীবি গ্রুপগুলোর আহবানে সর্বাত্মক হরতাল পালিত।

: বেগম খালেদা জিয়া ঐদিন গুলিস্তান চত্ত্বরে আহুত বিশাল জনসভায় বলেন চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত জনগণ রাজপথ ছেড়ে যাবে না।

 

১১ নভেম্বর ’৯০

: সরকারের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অধ্যাদেশকে অগ্রাহ্য করে ডাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়া হয়।

: এটা সরকারের বড় ধরনের প্রশাসনিক ও নৈতিক পরাজয় বলে চিহ্নিত।

 

১২ নভেম্বর ’৯০

:  স্কুল ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস বর্জন।

 

১৩ নভেম্বর ’৯০

:  বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন ঘোষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে ঢাকায় মৌন মিছিল অনুষ্ঠিত।

 

১৪ নভেম্বর ’৯০

:  সারাদেশে জেলা-উপজেলা ঘেরাও কর্মসূচির অংশ হিসেবে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য ঢাকা জেলা প্রশাসনে স্মারকলিপি প্রদানের উদ্দেশ্যে মিছিল।

:  সরকারী পক্ষের সমাবেশ চেষ্টা। আল্লাহ ওয়ালা ভবন প্রাঙ্গনে শাহ মোয়াজ্জেমের আস্ফালন।

 

১৫ নভেম্বর ’৯০

:  আদমজী থেকে সরকারী সমাবেশে শ্রমিক আনতে গিয়ে ৫ জন নিহত। খালেদা জিয়ার প্রতিবাদ।

 

১৬ নভেম্বর ’৯০

:   মোহাম্মদপুরে টাউন হলের সামনে জনসভায় খালেদা জিয়া বলেন-এরশাদের পদত্যাগ এখন সময়ের দাবী।

:  শিক্ষক সমাজের তরফ থেকে আন্দোলনকে সহায়তা করার জন্য সম্মিলিত শিক্ষক আন্দোলন গঠিত।

 

১৭ নভেম্বর ’৯০

:  সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের গণদুশমন দিবস পালিত। গণদুশমন ঘেরাও এর নামে মন্ত্রী পাড়া ঘেরাও করার কর্মসূচী পালিত। অপর পক্ষে সরকার আইন শৃঙ্খলার বাহিনীর উপরও ভাড়াটিয়া গুন্ডা এবং মাস্তান এতে মন্ত্রীদের রক্ষা করার চেষ্টা করে। ছাত্রদের সাথে ঐসব মাস্তানদের সংঘর্ষের অনেক ঘটনা ঘটে।

:   দেশের ৮টি যুব সংগঠন ‘যুব সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম গড়ে তোলে।

 

১৮ নভেম্বর ’৯০

 :   জাতীয় পার্টির সমর্থক গোষ্ঠী তথা পেশিশক্তির সাথে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ছাত্র জনতার সংঘর্ষ।

 

১৯ নভেম্বর ’৯০

:   তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রুপরেখা ঘোষিত। এই দিন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি মাইল ফলক। আন্দোলনরত সকলপক্ষ ও শক্তি একটি অন্তবর্তীকালীন তত্ত্ববধায়ক সরকারের রুপরেখা সম্পর্কে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত পৃথক পৃথকভাবে স্ব স্ব সমাবেশে ঘোষণা করে।

কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ অথচ স্পর্শকাতর বিষয়ে মীমাসিংত হতে হয়। বেগম খালেদা জিয়ার উদারতা এবং সম্মতিতে পৌঁছার জন্য জোরাগিদ ‘অসম্ভব’কে সম্ভব করে তোলে।

ঘোষিত রুপরেখা

 ১. হত্যা, ক্যু, চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের ধারায় প্রতিষ্ঠিত স্বৈরাচারী এরশাদ ও তার সরকারের শাসনের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাকল্পে।

ক) সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রেখে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট বিধান অনুযায়ী তথা সংবিধানের ৫১ অনুচ্ছেদের (৩) ধারা এবং ৫৫ অনুচ্ছেদের (ক)১ ধারা এবং ৫১ অনুচ্ছেদের ৩নং ধারা অনুসারে এরশাদ ও তার সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করে স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনরত তিন জোটের নিকট গ্রহণযোগ্য একজন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ করবেন। বর্তমান সরকার ও সংসদ বাতিল করে রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করে উক্ত উপ-রাষ্ট্রপতির নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।

খ) এই পদ্ধতিতে উক্ত ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে একটি অন্তবর্তীকালীন তত্ত্ববধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে যার মূল দায়িত্ব হবে তিন মাসের মধ্যে একটি সার্বভৌম জাতীয় সংসদের অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা।

২.ক) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ হবেন অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোন রাজনৈতিক দলের অনুসারী বা দলের সাথে সম্পৃক্ত হবেন না অর্থাৎ তিনি রাষ্ট্রপতি, উপ-রাষ্ট্রপতি বা সংসদ সদস্য পদের জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহন করবেন না। তার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোন মন্ত্রী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না।

খ) অন্তর্বতীকালীন এই সরকার শুধুমাত্র প্রশাসনের দৈনন্দিন নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনাসহ অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন পুর্ণগঠন ও নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম ও দায়িত্ব পুনবিন্যাস করবেন।

গ) ভোটারগণ যাতে করে নিজ ইচ্ছা ও বিবেক অনুযায়ী প্রভাবমুক্ত ও স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে সেই আস্থা পুনঃস্থাপন এবং তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।

ঘ) গণ-প্রচার মাধ্যমকে পরিপূর্ণভাবে নিরপেক্ষ রাখার উদ্দেশ্যে রেডিও, টেলিভিশনসহ সকল রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমকে স্বাধীন ও স্বায়ত্ত্বশাসিত সংস্থায় পরিণত করতে হবে এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বি সকল রাজনৈতিক দলকে প্রচার-প্রচারণায় অবাধ সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।

৩. অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সার্বভৌম সংসদের নিকট অন্তর্বতীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন এবং এই সংসদের নিকট সরকার জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবেন।

৪.ক) জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতির ভিত্তিতে দেশে সাংবিধানিক শাসনের ধারা নিরঙ্কুশ ও অব্যাহত রাখা হবে এবং অসাংবিধানিক যে কোন পন্থায় ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা প্রতিরোধ করা হবে। নির্বাচন ব্যতিত অসাংবিধানিক বা সংবিধান বহির্ভূত কোন পন্থায় কোন অজুহাতেই নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না।

খ) জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা হবে।

গ) মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি সকল আইন বাতিল করা হবে।

 

২০ নভেম্বর ’৯০

:  ঘোষিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহবানে সর্বাত্মক হরতাল পালিত।

: সর্বত্র সরকারী পেটোয়া বাহিনীর আক্রমণ।

: সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য কর্তৃক প্রবল প্রতিরোধের চেষ্টা।

 

২১ নভেস্বর ’৯০

:  ছাত্র ঐক্যের আহবানে ‘গণপ্রতিরোধ ও বিক্ষোভ দিবস’পালিত।

: বেগম খালেদা জিয়া গুলিস্তানের জনসভায় জিয়া শাহাদতের জন্য সরাসরি এরশাদকে দায়ী করেন।

: পর্যবেক্ষকদের মতে সরকার বিরোধী আন্দোলন গণজোয়ারে পরিণত হয়েছে।

 

২২ নভেম্বর ’৯০

:  সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ঢাকা কলেজের মিছিলে সরকার সমর্থকদের গুলিবর্ষণ।

 

২৩ নভেম্বর’৯০

:  বিএনপি ডাকা মহানগর শাখার উদ্যোগে বিশাল মিছিল।

: খালেদা জিয়া জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল থেকে কতিপয় সন্দেহভাজন এবং সন্ত্রাসীকে বহিষ্কার করেন।

 

২৪ নভেম্বর ’৯০

: বহিষ্কৃত সন্ত্রাসীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালায়।

 

২৫ নভেম্বর ’৯০

:  সরকারী সন্ত্রাসীদের ক্যাম্পাস দখলের চেষ্টা। রীতিমত যুদ্ধ। সাধারণ ছাত্রদের শক্তপ্রতিরোধের মুখে তাদের পলায়ন।

: সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেলদের সাথে এশাদের বৈঠক।

: চলমান পরিস্থিতিতে তাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা বলে ধারণা পর্যবেক্ষকদের।

 

২৬ নভেম্বর ’৯০

: অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের জমায়েত।

: সরকারী পেটোয়া বাহিনীর শহিদুল্লাহ হল ও এফএইচ হল দখল। ছাত্রদের প্রতিহতের চেষ্টা।

: নূর হোসেন চত্বরে ছাত্র সমাবেশ। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য কর্তৃক পরবর্তী ৭দলের কর্মসূচী ঘোষিত।

 

২৭ নভেম্বর’৯০

:  ঢাকা বিশ্ববিদ্য্যালয় চত্ত্বরে সরকারী সন্ত্রাসীদের অনুপ্রবেশের চেষ্টা।

 

 

ডা. মিলনের মৃত্যু

 

সকালের দিকে সন্ত্রসীরা কলাভবন এলাকা দখলের পদক্ষেপ নেয়। সাধারণ ছাত্রদের ধাওয়া খেয়ে তারা বাংলা একাডেমীর দিকে চলে যায়। এ সময় তারা বাংলা একাডেমীর দিক থেকে টিএসসির দিকে গুলি ছোড়ে। এ দিন ছিল চিকিৎসকদের কর্মবিরতি। ডা. শামসুল আলম খান মিলন ছিলেন বিএমএর যুগ্ন মহাসচিব। একটি সভায় যোগদানের জন্য তিনি যাচ্ছিলেন পিজি হাসপাতালে। তখন বেলা ১১টা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরীর পূর্ব দক্ষিণ কোনে বিএমএ মহাসচিব ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের সাথে তার দেখা। তিনি উঠলেন মোস্তফা জালালের রিকশায়। রিকশা চালু হতে না হতেই গুলিবিদ্ধ করে তাকে। নিয়ে যাওয়া হয় তাকে ঢাকা মেডিকেলের ইমারজেন্সীতে। কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

 

ঢাকায় মিলনের মৃত্যু এরশাদের মৃত্যু ঘন্টা বাজিয়ে দেয়। জাতীয় প্রেসক্লাবে তার লাশ এসে পৌঁছালে জনসমুদ্রের রুপধারন করে। বিএমএ এরশাদের পতন না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম ধর্মঘটের সিন্ধান্ত নেয়। ঢাকা মেডিকেলের অধ্যক্ষসহ সবাই একযোগে পদত্যাগ করেন। মিলনের মৃত্যু তড়িতাহতের মত সবাইকে উত্তেজিত করে তোলে। পেশাজীবিরা, নিরীহ মানুষেরা, গোটা বাংলাদেশ আন্দোলন উম্মুখ হয়ে ওঠে।

 

 

জরুরি অবস্থা ঘোষণা

 

স্বৈরাচারী মরণ কামড় দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করে। সান্ধ্য আইন জারি করে লোকজনের বহির্গমন সভাসমাবেশ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। রাত ৯:৩০ টায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে রাষ্ট্রপতি এরশাদ সংবিধানের ১৪১(ক) ধারা মোতাবেক পদত্ত ক্ষমতাবলে সারাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। জরুরি অবস্থা ও প্রেস সেন্সরশীপ আরোপের খবর শোনার সাথে সাথে সাংবাদিকরা পূর্ব সিন্ধান্ত অনুযায়ী পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ করে দেন। জরুরি অবস্থা ঘোষণার খবর শোনার পরপরই কারফিউকে উপেক্ষা করে লোকজন একদফার দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। এরশাদের সর্বপরিকল্পনা ভেস্তে যায়।

 

 

খালেদা-হাসিনাকে গ্রেফতারের নির্দেশ

 

এ দিন এরশাদের চট্টগ্রামে নানা কর্মসূচি ছিল। সেখানে বিরুপ সংম্বর্ধনা এবং এখানে মিলনের মৃত্যু সংবাদ তাকে দৃশ্যত অস্বাভাবিক করে তোলে। তিনি ঢাকা এসেই বেগম খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। এরশাদের নির্দেশ পেয়ে মুহুর্তের মধ্যে ডিসি সাউথের নেতৃত্বে পুলিশের একটি ঝটিকা বাহিনী ছুটলো খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করতে। রাজপথের দায়িত্ব সেরে সবে মাত্র ঘরে ফিরেছেন খলেদা জিয়া। গোপনসূত্রে খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবেই বেরিয়ে পড়েন খালেদা জিয়া। তার বেরুবার পথেই পুলিশের গাড়ী দেখেন তিনি। পুলিশ কিছু বুঝে ওঠার আগেই বড় রাস্তায় বেরিয়ে বেড়িয়ে পড়েন তিনি। গাড়ীর ড্রাইভার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণকে উপেক্ষা করে কাকরাইল মোড়ে আসে। গ্রেফতার এড়াবার কৌশল হিসেবে গাড়ী বদল করেন তিনি। আত্মগোপন করে তিনি। গ্রেফতার এড়িয়ে আত্মগোপন সিন্ধান্ত নেন আন্দোলনের সঙ্গে। ওদিকে শেখ হাসিনা মহাখালীস্থ তার স্বামীর বাসভবনেই অন্তরীণ করা হয়।

 

 

২৮ নভেম্বর ’৯০  সান্ধ্য আইনকে উপেক্ষা করে মিছিল

 

ঘোষিত সান্ধ্য আইন জরুরি আইন উপেক্ষা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত ছাত্র-ছাত্রী এদিন সকাল সকালই ক্যাম্পাসে মিছিল করতে থাকে। ক্যাম্পাস প্রকম্পিত হয় মিছিলে শ্লোগান যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয়ের পর প্রেসক্লাব হয়ে মতিঝিলের দিকে এগুতে থাকে। বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে বিডিআর আর পুলিশ যৌথভাবে হামলা চালায় মিছিলের উপর। আরও হামলা এবং আরও বিভক্ত হওয়ার পরও নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হয় তারা। অপরদিকে ছাত্রদল নেতার নেতৃত্বে পিজি এর ডাক্তাররাও রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। এটি ছিল ছাত্র-ছাত্রীদের স্বতস্ফূর্ত মিছিল। বিকেলে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ব্যানারে আর একটি মিছিল শুরু হয়। শিশু একাডেমীর গেটে পুলিশী আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিলটি।

 

দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এক জরুরি বৈঠকে মিলিত হয়। বিকেলে শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহমদ ঘোষণা করেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং ছাত্র জনতার উপর নিপীড়নের প্রতিবাদে একযোগে পদত্যাগ করবেন তারা। সর্বত্র আন্দোলনের  সর্বাত্মক প্রস্তুতি লক্ষ্য করা যায়। মালিবাগে ছাত্র জনতা রেলপথ অবরোধ করে। এখানে পুলিশের গুলিতে দু’জন নিহত হয়। বিক্ষুব্ধ লোকজন জাতীয় পার্টির ধানমন্ডি অফিস আক্রমণ করে। এভাবে ঢাকা শহরের অলিগলিতে মানুষ সংগঠিত হয়। দেশের সর্বত্র থেকে অসংখ্য প্রতিরোধ আর অসংখ্য মৃত্যুর খবর আসতে থাকে।

 

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, ভিসি, প্রো-ভিসির পদত্যাগ,  উত্তাল ঢাকা

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিরাপদ প্রস্থান নিশ্চিত করার জন্য সান্ধ্য আইন শিথিল করা হয়। কিন্তু ছাত্র শিক্ষক সকলের সিদ্ধান্ত হল ত্যাগ না করা। পুলিশ হল খালি করতে এলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়শত শিক্ষক পদত্যাগের ঘোষণা দেন। শহীদ মিনার থেকে শিক্ষকদের মিছিলটি উপাচার্যের কার্যালয়ে আসেন। উপ-উপাচার্য প্রফেসর এমাজউদ্দিন আহমদ সাথে সাথেই পদত্যাগ করেন। উপাচার্য প্রফেসর ড. মুনিরুজ্জামান মিয়া শিক্ষকদের সম্মানে তাৎক্ষণিকভাবে পদত্যাগ করেন। ছাত্রদের মিছিলের আর্বতন-বিবর্তন চলতেই থাকে। ঢাকা মহানগরী মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়।

 

সরকারী সন্ত্রাসীরা বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বাসায় বাসায় হামলা চালায়। নগরীর বিভিন্ন স্থানে ছাত্রজনতার সাথে পুলিশ বিডিআর এর সংঘর্ষে অসংখ্য নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। মিরপুরে বেশী উত্তাপ পরিলক্ষিত হয়। এখানে ৭ জন মারা যায়। এমনকি এক বাসায় মায়ের কোলে থাকা এক নিষ্পাপ শিশু মারা যায়। ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন সরকারী হুমকী কারফিউর গুলি আর জরুরি অবস্থার গ্রেফতারী উপেক্ষা করে রাজপথে জনতার সাথে শামিল হয়। তারা ঘোষণা দেয় যতদিন পর্যন্ত জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করা না হয় ততদিন তারা পত্রিকা বের করবেন না।

 

১ ডিসেম্বর ’৯০

:  সরকার সান্ধ্য আইন শিথিল করে। কিন্তু বিরোধী দলের আহবানে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালিত হয়।

: মিরপুরসহ সর্বত্র জনতার সাথে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ তীব্র আকার ধারণ করে। নির্বিচারে গুলিচালন।

: দুপুরে প্রেসক্লাবের সামনে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

 

 

বেগম খালেদা জিয়ার স্বহস্তে লিখিত বিবৃতি

 

আত্মগোপন অবস্থা থেকে ৭ দলীয় জোট নেত্রী খালেদা জিয়া একটি স্বহস্তে লিখিত বিবৃতি প্রচারের জন্য প্রেসক্লাবে পাঠান। বিবৃতিটি হলো:

সংগ্রামী দেশবাসী,

আচ্ছালামু আলায়কুম। আপনারা জানেন স্বৈরাচারী খুনী এরশাদ সরকারের দুঃশাসনে দেশ আজ এক চরম সঙ্কটজনক অবস্থায় নিপতিত। দীর্ঘ নয় বছরে দেশীয় সম্পদ লুট, গণতন্ত্র হত্যা, সর্বপরি দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে এই স্বৈরশাসক গোটা দেশ ও জাতির অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছে। এই দুঃশাসন থেকে মুক্তি পাবার জন্য আমরা দীর্ঘদিন যাবত লড়াই করে আসছি। সকল ভেদাভেদ মত পার্থক্যকে উর্দ্ধে রেখে সকল রাজনৈতিক জোট ও দল, ছাত্র-জনতা তথা সর্বস্তরের পেশাজীবিরা স্বৈরাচারের উৎখাত করে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু করেছে।  আর সেই আন্দোলন নস্যাৎ করার লক্ষ্যে এই দেশদ্রোহী সরকার জঘন্য ও জঙ্গী পদক্ষেপ গ্রহণ করে ছাত্র-জনতার উপর বেপরোয়া গুলিবর্ষণ, নির্যাতন, গ্রেফতার, জরুরি আইন ও কারফিউ জারি করে চলেছে। শুধু তাই নয়, ভাড়াটিয়া সশস্ত্র গুন্ডাবাহিনী দিয়ে ব্যাপক গোলাগুলি করে হত্যাকান্ড সংগঠনের মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনের পবিত্রতাকে করেছে কলুষিত, সভ্যতাকে করেছে কলংকিত, জারি করেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ’৯০ অধ্যাদেশ কালাকানুন। আপনারা জানেন, জরুরি আইন ও সরকারের জঘন্য পদক্ষেপ ও কালাকনুনের প্রতিবাদে ইতিমধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য ও শিক্ষকবৃন্দ এবং বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েসনের আহবানে দেশের সকল চিকিৎসকগন ইতিমধ্যেই পদত্যাগ করেছেন। দেশের সাংবাদিক সমাজ স্বৈরাচারী এরশাদ পতদ্যাগ না করা পর্যন্ত তাঁদের কলম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এছাড়া দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দও পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি তাদের এই পদক্ষেপকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই। আপনারা এও জানেন, স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে যখন কোনক্রমেই বন্ধ করতে পারছেনা তখন অবৈধ মন্ত্রী ও এরশাদের দালালরা গা ঢাকা দিয়ে জনগণের সম্মুখে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে যেটা দেশবাসী কোন দিন প্রত্যাশা করেনি। আজ দেশে স্বৈরাচারের নির্দেশে যে শত শত জনসাধারণ প্রাণ হারাচ্ছে ও আহত হচ্ছে তা যাতে দেশবাসী ও বহির্বিশ্বে জানতে না পারে সে জন্য সমস্ত যোগাযোগ ও খবরা খবরের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রন আরোপ করা হয়েছে। তাই আমি দেশ ও জাতির সংকটময় মুহুর্তে দেশপ্রেমিক  সকল সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের সকল স্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রতি জোর আহবান জানাচ্ছি, আপনারা পদত্যাগ করে জনতার আন্দোলনে শরীক হোন এবং খুনী এরশাদের  যে কোন কার্যকলাপের প্রতি পুর্ণঅসহযোগিতা করুন। আমি সমস্ত হহত্যাকান্ড, নির্যাতন ও নিষ্পেষনকে উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনকে এগিয়ে যে বীরগাথা ইতিহাস সৃষ্ঠি করে চলেছে তার জন্য সকলকে সংগ্রামী শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। সাথে সাথে স্বৈরাচারী এরশাদকে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারন করে বলতে চাই, অবিলম্বে পদত্যাগ করো এবং সংগ্রামরত জনতার উপর গুলিবর্ষণ ও নির্যাতন বন্ধ করো। অন্যথায় এর পরিণাম ভয়াবহ হবে “গণতান্ত্রিক সংগ্রামের বিজয় অনিবার্য। আপনাদের সবাইকে সংগ্রামী অভিনন্দন”।

 

২ ডিসেম্বর ’৯০

:সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করে ১৪৪ ধারা জারি।

: গণবিক্ষোভের ব্যাপকতা তীব্রতা বৃদ্ধি পায়।

: আইনজীবিদের আদালত বর্জনের ঘোষণা।

:আত্মগোপন অবস্থা থেকে খালেদা জিয়ার বিবৃতি; পাড়াপাড়ায় গ্রামে গ্রামে গণসংগ্রাম কমিটি গঠনের আহবান।

 

 

বিসিএস সমন্বয় পরিষদের বিবৃতি

 

বিসিএস সমন্বয় পরিষদ পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যালোচনার পর প্রদত্ত বিবৃতিতে অভিযোগ করে যে, ‘জনজীবনের প্রতিকূল সরকারের ক্ষমতা প্রয়োগ করা হচ্ছে। যা সংবিধান লংঘনই নয় বরং জনগণের সকল মানবাধিকারের অস্বীকৃতি।’ সচিবালয়ের কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এসে আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে। এভাবে এদিন এরশাদ সরকারের বেসামরিক প্রশাসন তার কার্যকারিতা হারায়।

 

৩ ডিসেম্বর ’৯০ : জাতীয় প্রেসক্লাব এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস

প্রেসক্লাব এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সব সময় কিছু লোক থাকে।

: ক্যাম্পাস এবং নগরীতে স্থানে যথারীতি মিছিল।

: সচিবালয় অভ্যন্তরে কর্মকর্তাদের মিছিল। বিপুল সংখ্যক কর্মচারী তাদের অনুগামী হয়।

: অফিসে অফিসে পদত্যাগের হিড়িক।

: এরশাদের আলোকচিত্র অপসারিত।

: এনজিও-দের একাত্মতা প্রকাশ।

: পত্রিকা বের করার সরকারী প্রচেষ্টা ব্যর্থ।

: বিরোধীদের পক্ষে বিদ্রোহ আজ বিপ্লব চারিদিকে। বুলেটিন ইত্যাদি প্রকাশিত হতে থাকে।

 

জনতার নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আত্মগোপন অবস্থা থেকেই ৩ ডিসেম্বর রাতে ভয়েস অব আমেরিকায় টেলিফোনে সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘১০ অক্টোবর থেকে স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন চলছে। গত কয়েক দিন ধরে আন্দোলনে দাবানল এমনভাবে জ্বলে উঠেছে যে, এরশাদ দিশেহারা হয়ে জরুরি আইন, কারফিউ ও গুলির নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু তা অমান্য করে ছাত্র-শ্রমিক সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছে। এখন দেশে সরকার বলতে আর কিছু নেই। সব অচল হয়ে পড়েছে। নিরপেক্ষ সরকারের রুপরেখা দিয়েছি। এরশাদ যদি ভাল চায় তবে তাকে পদত্যাগ করতে হবে।”

 

 

সেনাবাহিনীর সমর্থন প্রত্যাহার

 

এ দিনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল সেনা সদর দপ্তরে সশস্ত্র বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ শেষে সিন্ধান্ত গৃহিত হয় ব্যক্তি বা দলের স্বার্থে সেনাবাহিনী ব্যবহৃত হবে না।  এ সিন্ধান্তের পর তিন বাহিনী প্রধান প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করেন। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে বলে প্রেসিডেন্ট এরশাদকে অবহিত করেন। জেনারেল এরশাদ সশস্ত্র বাহিনীকে ক্ষমতা গ্রহণের অনুরোধ জানালে তারা তা অস্বীকার করেন।

 

 

এরশাদের পদত্যাগের ঘোষণা

 

প্রেসিডেন্ট জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে তার পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে জানাতে চান। তিনি তাঁর ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ের কথা জনগণকে জানান। তিনি বলেন দেশের অবস্থা দেখে তিনি ব্যথিত। তিনি তার ভাষণে আর বলেন সমস্ত বিরোধিতা ও মতভেদের মূল দূর করতে চান। রাজনৈতিক জীবন থেকে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সংশয় দূর করতে চান। ক্ষমতা হস্তান্তরের বিকল্প হিসেবে তিনি উল্লেখ করেনঃ

ক) ১ ডিসেম্বর থেকে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করা হবে।

খ) একই দিনে রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

গ) নির্বাচনের ১৫ দিন পূর্বে তিনি একজন নিরপেক্ষ উপ-রাষ্ট্রপতির নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।

 

 

বেগম খালেদা জিয়ার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া

 

বিবিসির সাথে বেগম খালেদা জিয়া তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেনঃ ‘সাত, আট ও পাঁচ দলসহ আরও অন্যান্য রাজনৈতিক দল মিলে আমরা যে রুপরেখা দিয়েছি, সে অনুযায়ী সে বলেছে ভাইস-প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করবে...অবিলম্বে তাকে তা করতে হবে।...১৫ দিন আগে নয় এক্ষুণি করা উচিত। তার প্রস্তাব আমরা মানিনা। এক্ষুণি। অবিলম্বে তাকে পদত্যাগ করতে হবে।

 

৪ ডিসেম্বর ’৯০

: এ দিনটি তিনজোট ও জামায়াতে ইসলামী আহূত হরতারের প্রথম দিন।

: নগরীর সর্বত্র তার তাৎক্ষণিক পদত্যাগ চাওয়া হয় এবং ভাষণ প্রত্যাখান করা হয়।

 সকাল ৯:০০ : জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকা লোকে লোকারণ্য।

 সকাল ১০:০০

: বিসিএস ক্যাডার এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারীদের মিছিলের একাত্মতা।

: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনুরুপ মিছিল।

: মতিঝিল এলাকার বিভিন্ন ব্যাংক, বীমা কর্পোরেশন থেকে অনুরুপ মিছিল।

: প্রতিদিন জনগণকে খবর দেবেন বলে সাংবাদিক ইউনিয়নের ঘোষণা।

: সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট পল্টন মোড়ে বিকল্প সম্প্রচার কেন্দ্র চালু করবে।

: কর্তব্যরত আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা।

: ৭ দলীয় জোটের জনসভা। কয়েকদিন আত্মগোপনের পর এই দিনই প্রথম জনসম্মুখে আসেন। জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। সভাশেষে মিছিলে নেতৃত্বে দেন।

 

 

বেগম খালেদা জিয়ার ভাষণ

 

জনসমুদ্রে খালেদা জিয়া বলেন, মহান শহীদদের আত্মত্যাগ ও জনতার আন্দোলন সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। স্বৈরাচারী এরশাদ কাইত হয়েছে। এখন জোরে একটু ধাক্কা দিতে হবে। ‘...এরশাদের হাত জিয়াউর রহমানের রক্তসহ অগণিত ছাত্র-জনতার রক্তে রঞ্জিত। এরশাদের পতন না হওয়া পর্যন্ত হরতাল চলবে।’

 

 

এরশাদের পদত্যাগ

 

উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনার জন্য তিন বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা বিকেলে বৈঠক করেন। তারা মনে করেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি একব্যক্তি এরশাদ ও সমগ্র জাতির মধ্যে সরাসরি সংঘাতমূলক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীর জাতির বৃহত্তর স্বার্থই চিন্তা করছে। সুতারাং সশস্ত্র বাহিনী এরশাদ বা জাতীয় পার্টিকে আর সমর্থন দিতে পারে না। সেনাবাহিনীর এই ম্যাসেজ পাওয়ার পর তিনি বিশ্বে যোগাযোগ করেন। কোথাও থেকে তেমন আশা পাওয়া যায়নি। দেশে-বিদেশে কোথাও কোন আশার আলো দেখতে না পেয়ে তিনি পদত্যাগের সিন্ধান্ত নেন।

 

রাতে যখন এরশাদের পদত্যাগের খবর শোনেন তখন একটা খোলা জীপে রাজপথে বেরিয়ে পড়েন বেগম খালেদা জিয়া। এ সময় রাজপথ ছিল জনতার ঢল। জীপটি প্রেসক্লাব হয়ে নগরী প্রদক্ষিণ করে। আনন্দ উদ্বেল জনতা এখানে সেখানে যখনই তাকে দেখেছে ঘিরে ধরেছে। উল্লাস প্রকাশ করেছে। অভিনন্দন জানিয়েছে। কারো সাথেই আনুষ্ঠানিক আলাপ আলোচনা পরামর্শ নির্দেশনা ইত্যাদি চাননি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ পদত্যাগ পত্রটি লেখেন। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সম্পাদনা করেন। রাত ১০টার বিটিভির সংবাদ ফুটেজে সর্বপ্রথম খবরটি আসে। অতিদ্রুত বিবিসির আতাউস সামাদ পিকআপ করেন বিষয়টি।

 

টেলিভিশনে রাত ১০ টার ইংরেজী সংবাদে ১০টা ১৩মিনিট বাজতেই খবর পাঠকের সামনে এসে হাজির হল একটি চিরকুট। খবর রেখেই সংবাদ পাঠক পড়লেন ‘হেয়ার ইজ এ ফ্লাশ’ প্রেসিডেন্ট এরশাদ পদত্যাগ করার সিন্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি জোটের মনোনীত ভাইস প্রেসিডেন্টের কাছে পদত্যাগ করবেন। সংবাদটি ঘোষিত হওয়ার পরপরই ঢাকা যেন ভেঙ্গে পড়ল। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে গেল। লাখো জনতা নেমে এল রাজপথে। সে ছিল এক বিরল দৃশ্য। ৫ ডিসেম্বর ’৯০ যেন জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার। রাজধানীর রাজপথ ছিল এদিন জনসমুদ্র। লাখ লাখ মানুষের উপচে পড়া ভিড় এই নগরীকে মনে হয়েছে যেন মানুষের এক সাগর। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মানুষের অন্তহীন ঢেউ এই সাগরে যেন তরঙ্গ তুলেছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম গণআন্দোলনের মুখে একজন শাসককে বিদায় নিতে হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভের পর ঢাকায় মানুষের যে ঢল নামে কেবল তারই সঙ্গে সেদিনে গণজোয়ারের তুলনা করা চলে। শ্লোগানে শ্লোগানে সেদিন রাজধানী কাঁপছিল। উল্লাসিত মানুষের উদ্যম নৃত্য চলে রাতভর দিনভর। ৪ ডিসেম্বর রাত থেকে রাজধানীতে যে জনতার মিছিল শুরু হয়। অব্যাহত ভাবেই চলছিল সেই বিজয় মিছিল। সেদিন ঢাকা ছিল উৎসব নগরী। এরশাদ সরকারের পতন উপভোগ করতে রাজধানী শহর ঢাকায় জনতার ঢল নামে। জীবনে যারা মিছিলে যায়নি। তারাও শরিক হয় বিজয় মিছিলে। স্বপরিবারে এসেছে মানুষ। শিশু, মহিলা, নবীন, প্রবীন কেউউ বাদ পড়েনি এই বিরল আনন্দ মিছল থেকে। ঢাকার সেদিন ছিল এক অভিনব রুপ। এক অভূতপূর্ব দৃশ্য রঙ ছিটিয়ে আনন্দ উল্লাস ব্যান্ডের তালে তালে নৃত্য আর হৈ হৈ এরশাদ গেল কই। শ্লোগান নগরীর মধ্যে নতুন ব্যঞ্জনা আনে। শহরতলী ও কাছাকাছি মফস্বল শহর থেকে শত শত ট্রাক, বাসে করে লোকজন আসতে থাকে রাজধানীতে, সবার হাতে বাংলাদেশের পতাকা। একই সাথে চলে বর্ণাঢ্য মটর সাইকেল মিছিল, রিকশা মিছিল এবং ঘোড়াগাড়ি টমটমে সজ্জিত মিছিল। এসব মিছিলে ছিল নেতানেত্রীর বিশাল প্রতিকৃতি।। মিছিলে এরশাদ ও রওশন এরশাদের কুশপুত্তলিকা নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করা হয়। শিল্পীদের আঁকা এরশাদের ব্যঙ্গ চিত্র দেখা যায় নগরীর সর্বত্র। কার্টুন ও বৈচিত্রময় পোস্টারে ছেয়ে যায় নগরীর দেয়াল। দৈনিক পত্রিকাগুলোর টেলিগ্রাম কিনতে ভিড় করে মানুষ। মোড়ে মোড়ে উল্লসিত জনতা মেতে উঠে কৌতুক আনন্দে। জারিগান, প্যারডি ও কোরাস গাইতে থাকে তারা। মানুষের চোখেমুখে ছিল বিজয়ের অভিব্যক্তি ব্যঙ্গচিত্রগুলো মানুষকে বেশ আনন্দ দেয়। একটি ব্যঙ্গ ছিল এমন গলায় দড়ি বাঁধা এরশাদের উদ্বিগ্ন চেহারা। শিরোনামে ছিল ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে......................।

 

এমনিভাবে ব্যঙ্গ চিত্র ছিল রওশন এরশাদ ও তার মন্ত্রীদের । মিছিলে কারও হাতে ছিল খালেদা জিয়া ও জিয়াউর রহমানের ছবি। আবার কারও কারও হাতে ছিল শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি। জনতা বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে ফুল ছিটিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছে সেদিন। তারাও সেদিন বিশাল জনসমুদ্রে জনগণের প্রতি কৃতঙ্গতা প্রকাশ করেন। ৬ ডিসেম্বর ’৯০ বঙ্গভবনে ছিল এক অবূর্তপূর্ণ দৃশ্য রাজনৈতক নেতাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ। ৩টা বাজার পর থেকে নেতারা বঙ্গভবনে যাওয়া শুরু করেন। বঙ্গভবনের দরবার হলে আয়োজন করা হয়েছিল এই সমাবেশের। সেদিন ঠিক ৩টা ৫৮মিনিটে মজিদ উল হক ও মিসেস ফরিদা হাসানকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকলেন বেগম খালেদা জিয়া বিপুল সংখ্যক আলোকচিত্র সাংবাদিকদের ক্যামেরার ফ্লাশে মুহুর্মুহু ঝলসে উঠতে থাকল দরবার কক্ষ। আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা সোয়া ৪টায় বঙ্গভবনে ঢুকতেই আবার ঝলসে উঠে ক্যামেরার ফ্লাশ। দুই নেত্রীকে একই সোফায় পাশাপাশি পেয়ে ছেকে ধরেন। আলোকচিত্র সাংবাদিকরা। তাদের ছবি তোলা যেন আর শেষ হতে চায়না। কে কত ব্যতিক্রমী ছবি তুলতে পারেন যেন এরই প্রতিযোগিতা। এরই মাঝে দুই নেত্রী টুকটাক কথা বলতে থাকেন। বিকাল ৪টা ২৫মিনিটে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট দরবার হলে ঢুকেন। শ্রোতামন্ডলী মুখর করতালির মাধ্যমে অনুষ্ঠানকে প্রাণবন্ত করে তোলেন। সে ছিল এক বিরল দৃশ্য।

 

 

রাজপথ থেকে দেশনেত্রীর অভ্যুদয় এবং নির্বাচনী প্রচার অভিযান

 

অবৈধ এরশাদের অধীনে কোন নির্বাচন নয়-তিরাশী সালে আন্দোলনের শুরুতেই ঘোষণা করেছিলেন খালেদা জিয়া। এরশাদের একের পর এক নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছেন। খালেদা জিয়া প্রতিটি নির্বাচনই প্রত্যাখান করেছেন। এরই মধ্যে দেশে দুইটি সংসদ নির্বাচন, একটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, একটি গণভোট ও দুটি উপজেলা নির্বাচন হয়ে যায়। ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আট দল এবং জামায়তে ইসলামী অংশ নেয়। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া তার সিন্ধান্তে ছিলেন অনড় অটল। স্বৈরাচারের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তার সিন্ধান্ত থেকে এক চুলও নড়েননি। বেগম জিয়া ‘৮৬’র নির্বাচনকে নীলনকশার নির্বাচন এবং ‘৮৮’র নির্বাচনকে শতাব্দীর জঘন্যতম প্রহসন বলে আখ্যায়িত করেন। বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে এ নির্বাচন ছিল গণতন্ত্রের ট্রাজেডি। এ নির্বাচনের বিরুদ্ধে অনড় থেকে দেশব্যাপী প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলায় চট্টগ্রামের এক মহাসমাবেশে বেগম খালেদা জিয়াকে ‘দেশনেত্রী’ উপাধী দেয়া হয়।

 

বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, একমাত্র নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই কেবল তিনি নির্বাচনে যাবেন। অবশেষে এল সেই দিন। ৪ ডিসেম্বর ’৯০ গণঅভ্যুন্থানে স্বৈরাচার এরশাদের পতন হয়। ৬ ডিসেম্বর গণজোয়ারের মুখে এরশাদ পদত্যাগ করেন। ক্ষমতায় এল তিনজোট এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মনোনীত নির্দলীয় নিরপেক্ষ অন্তবর্তী সরকার। অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হলেন বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ। ঘোষণা হল ২৭ ফেব্রুয়ারী ’৯১ সার্বভৌম সংসদের নির্বাচন। দীর্ঘ নয় বছর পর মুক্ত পরিবেশে এই প্রথম খালেদা জিয়া ঘোষণা করলেন তিনি নির্বাচনে অংশ নেবেন। তারপর শুরু হল নির্বাচনী তৎপরতা।

 

ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দেশব্যাপী সৃষ্টি করলেন এক গণজোয়ার। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারী দুটি মাস চষে বেড়ালেন তিনি সারা বাংলাদেশ। রাতদিন চব্বিশ ঘন্টাই চলো তার ক্লান্তিহীন প্রচারাভিযান। সে ছিল এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। সিলেটের হযরত শাহজালাল (রঃ) এর মাজার জিয়ারত করে তিনি এই যে শুরু করলেন, ২ ফেব্রুয়ারী ঢাকার শেরে বাংলা নগরে স্মরণাতীতকালের বৃহত্তম নির্বাচনী সমাবেশের মাধ্যমে শেষ করলেন নির্বাচনী প্রচারণা। এ সময় খালেদা জিয়া প্রায় আঠারশ জনসভা ও পথসভায় ভাষণ দিয়েছেন। এর মধ্যে নির্ধারিত জনসভার সংখ্যাই আটাশ। নির্বাচনী প্রচারণা চলাকালে তিনি একবার একটানা ৪৮ঘন্টা না ঘুমিয়েও কাটান। একদিন সর্বোচ্চ ৩৮টি জনসভায় বক্তৃতা করারও তার রেকর্ড রয়েছে।

 

এসময় তিনি গড়ে দু’ঘন্টার বেশী ঘুমাননি। সিলেটে হয়রত শাহজালাল (রঃ)-এর মাজার জিয়ারতের পর প্রথম দফায় তিনি উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলায় নির্বাচনী প্রচার চালান। এরপর দক্ষিণবঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গে যান প্রচারাভিযানে। এসমায় দেশবাসী দেখেছেন, তার বক্তৃতা কৌশল, কিভাবে একাত্ম হয়ে যান সাধারণ মানুষের মাঝে, ভোট চাওয়ার কৌশল, তার ধৈয্য এবং পরিশ্রম করার মানসিকতা। কোন কোন জনসভা তিনি জ্বালাময়ী বক্তৃতা আবার কোনটিতে জনতাকে হাসিয়ে উল্লেসিত করেছেন। তার বক্তৃতা শোনার জন্য ঝড়-বৃষ্টি বাদল উপেক্ষা করে মানুষকে দেখেছি হুমড়ি খেয়ে পড়তে। তন্ময় হয়ে জনতা তার বক্তৃতা উপভোগ করেছে। কোন কোন জনসভায় জনতা স্লোগানে বিস্ফোরিত হয়েছেন। আবার কোনটিতে উল্লাস ধ্বনিতে মেতে উঠেছেন। ১৯৯১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারী থেকে ৮ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত পাঁচ দিন বেগম খালেদা জিয়া চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লায় মোট ৭১টি জনসভা করেন। চট্রগ্রাম আগ্রাবাদে তার জনসভা ছিল গত ষোল বছরের মধ্যে বন্দর নগরীতে বৃহত্তম জনসভা। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে, কুমিল্লার দেবিদ্বারের জনসভাও ছিল বিশাল। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে পাঁচ দিনের এই সফরে বেগম খালেদা জিয়া তার দলীয় প্রতীক ধানের শীষের পক্ষে অভূতপূর্ব জোয়ার সৃষ্টি করেন। সকাল থেকে শুরু করতেন প্রচার যাত্রা। পথে পথে হাজার নারী-পুরুষ তাকে দেখতে এবং তার কথা শোনার  জন্যে উম্মুখ হয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেছে। কোথাও রাস্তায় অপেক্ষমান জনতার দাবির মুখে গাড়ি থামিয়ে বক্তৃতা দিতে হয়েছে। অনেক জায়গায় জনতা রাস্তার উপর তাঁর গাড়ির সামনে শুয়ে পড়েছে। ফলে নির্ধারিত জনসভায় পৌঁছাতে অনেক বিলম্ব হয়েছে। ফেনীতে পৌঁছার কথাছিল সন্ধ্যায়, পৌঁছেছেন রাত সোয়া তিনটায়। ফেনীতে এত শীতের রাতেও পৌঁ দেখা গেল দশ-পনের হাজার মানুষ অপেক্ষা করছে, তার বক্তৃতা শুনতে । তার আগমনের উচ্চারিত ধ্বনি প্রচারিত হল ফেনী শহরে। রাতের ঘুম ভেঙে ফেনীবাসী দৌড়ে এসে হাজির হয় জনসভা স্থলে। ফেনীতে তিনি ২১টি জনসভায় বক্তৃতা করেন।

 

বেগম খালেদা জিয়ার নির্বাচনী বক্তৃতার সময় দারুণ রসপূর্ণ হয়েছে। জনগণ মজা পেয়েছে, আনন্দ পেয়েছে। কোন কোন বক্তৃতা হয়েছে জ্বালাময়ী। জনতাও আন্দোলিত হয়েছে তার বক্তৃতা শুনে। তবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে তিনি কোন বক্তৃতা দেননি। এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন সংযত। চট্টগ্রামের ভোটারদের উদ্দেশ্যে একটি জনসভায় খালেদা জিয়া বলেন, আপনার ভোট অত্যন্ত মূল্যবান। আপনার সঠিক সিন্ধান্তের উপর দেশের ভবিষ্যত নির্ভর করছে। ভোটের দিন সজাগ থাকবেন। সবাই মিলে ভোট কেন্দ্র আগলে রাখবেন। প্রয়োজনে লাঠি দিয়ে সন্ত্রাসীদের তাড়া করবেন। এ বক্তৃতা শুনে অনেকেই হেসে ফেলেন। পথে পথে অসংখ্য তোরণ নির্মিত হয়েছিল। চট্টগ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে হাটহাজারী জনসভায় তিনি বলেন, ধানের শীষে ভোট দিতে পারলে কৃষক মাঠে ফসল ফলাতে পারবে। ছেলেমেয়েদের বিনাপয়সায় লেখাপড়া শেখাতে পারবে। গণতন্ত্র পাবে, সুখে-শান্তিতে মানুষ থাকতে পারবে। তিনি জনতাকে বলেন, এদেশে তিনটি সরকার ছিল। আপনারা বলুন কোন সরকার ভাল ছিল। জনতা উত্তর দেয়, ধানের শীষ সরকার। এরপর তিনি বলেন, ধানের শীষ কথাদিয়ে কথা রাখে। স্বাধীনতার প্রথম সরকার কথা দিয়ে কথা রাখেনি। মানুষ না খেয়ে মরেছে। মানুষকে তারা বলেছিল বেলী ফুলের মালা দিয়ে বিয়ে করতে, আর নিজেরা করেছে সোনার মুকুট দিয়ে।

 

চট্টগ্রাম সফরের দ্বিতীয় দিনে বেগম জিয়া রাঙ্গুনিয়া পৌঁছালে সৃষ্টি হয় এক করুণ দৃশ্যের। বেগম জিয়া শহীদ জিয়ার প্রথম মাজারে ফাতেহা পাঠ করেন। বিদ্রোহীরা শহীদ জিয়াকে প্রথম এখানে কবর দিয়েছিল। এ সময় বেগম জিয়ার দুচোখ অশ্রুসজল হয়ে পড়ে। জিয়ার শূন্য কবরে তিনি পুলের মালা অর্পন করেন। রাতে ডাবলমুরিং এ বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়ে তিনি আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন। বেগম জিয়া বলেন, এই ডাবলমুরিং আমার নিজ এলাকা। প্রেসিডেন্ট জিয়া এখান থেকে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। মনে-প্রাণে ভালোবাসতেন এই চট্টগ্রাম ও তার জনগণকে। জিয়া চট্টগ্রামে একটি বাড়ি তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জীবদ্দশায় না পারলেও চিরদিনের বাড়ি তৈরি করে গেছেন। এ বক্তব্যে জনসভার অনেকেই কেঁদে ফেলেন। ডাবলমুরিং এ জনসভা শেষে রাত সোয়া তিনটায় ফেনী পৌঁছালে রাতে নিস্তব্ধতা ভেঙে শ্লোগান ওঠে গর্ব মোদের আলাদা, ফেনীর মেয়ে খালেদা। এরপর পাগলা বাবার মাজার জিয়ারত করে তিনি ফেনীতে জনসভায় বক্তৃতা দেন।

 

২০ ফেব্রুয়ারী বেগম খালেদা জিয়া তার শ্বশুরের দেশ বগুড়া জেলায় নির্বাচনী প্রচারণা চালান। সেটি ছিল এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা। বেগম জিয়ার গাড়ীটি থামতেই পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পল্লী রমণী, শিশু, কিশোর, বৃদ্ধা হুমড়ি খেয়ে পড়ে গাড়ির উপর। কেউ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, মহিলাদের কেউ হাত মেলাল, হাতে চুম্বন দিল। অনেকেই আবার তার গাড়িতে টাকা ছুড়ে দিয়েছে। পক্ককেশী একবৃদ্ধা ভিড় ঠেলে গাড়ির কাছে এগুনোর চেষ্টা করল, মাগো বউরে দেখতে দাও। আশি বছরের এক বৃদ্ধা বলল মাগো গৌরব, মাগো বউ খালেদা। খালেদা জিয়াকেও মনে হল, যেন তিনি শ্বশুর বাড়িতে এসেছেন। কাপড়ে ঘোমটা দেয়া খালেদা জিয়া অত্যন্ত বিনয়ের সাথে কথা বললেন। ভাল মন্দ জিজ্ঞাসা করলেন। বগুড়ার মানুষ তাকে সেদিনই জানিয়ে দেয় ভোটের জন্য তাকে সেখানে জনসভা করার দরকার নেই। তিনি সেখানে এত ভোট পাবেন যে, ভোট রপ্তানি করতে পারবেন। উত্তরবঙ্গের পাবনা-নাটোর এলাকায় প্রচার চালাতে গিয়ে পথে হঠাৎ তিনি গাড়ি থামান। বাড়ির আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে কিছু পল্লী রমণী তার গাড়িটি লক্ষ্য করছিল। তিনি গাড়ির কাঁচ নামিয়ে ওদের ডাকলেন। কাছে এলে তিনি বললেন-‘ধানের শীষে ভোট চাই, ভোট দেবেন তো। পল্লী রমণী হেসে বলল, আপা হামরা, হামাগ আপাকে ভোট দিয়া লাগবি। অর্থাৎ আপনি আমাদের আপা। আমরা আপনাকেই ভোট দেব। হাজার হাজার উৎফুল্ল জনতার শ্লোগান আর হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া ১ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তিনি জনসভায় বক্তৃতা দেন। এবং ৫০টি ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। ২৫ ফেব্রুয়ারী শেরে বাংলা নগরে বিশাল সমাবেশের মাধ্যমে তিনি নির্বাচনী প্রচারণা শেষ করেন। ১৯৮১ সালের জুন মাসের শহীদ জিয়ার জানাজার পর এতবড় সমাবেশ আর হয়নি। বেগম খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা যে ছিল সবার শীর্ষে সেদিন ওই জনসভা ছিল তার বহিঃপ্রকাশ। পুরো এলাকা ছিল এক উৎসব ও আনন্দমুখর এলাকা। এ সময় শ্লোগান উঠেছিল; সারা বাংলার ধানের শীষে-জিয়া তুমি আছ মিশে, দেশ গড়েছেন শহীদ জিয়া-নেত্রী মোদের খালেদা জিয়া, নেত্রী মোদের আপোষহীন-ধানের শীষে ভোট দিন, ধানের শীষে বিসমিল্লাহ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ। এ জনসভায় খালেদা জিয়া বলেন, আমাদের একহাতে জাতীয়তাবাদের পতাকা, অন্যহাতে স্বাধীনতার পতাকা। ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে গোলামির জিঞ্জির। গোলামির চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার কবল থেকে বাঁচতে চাইলে ধানের শীষে ভোট দিন।

 

বেগম খালেদা জিয়ার নির্বাচনী প্রচারের সবচেয়ে সফল দিকটি হল টেলিভিশনে ত্রিশ মিনিট জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ। ২ ফেব্রুয়ারী শেখ হাসিনার ৫৪মিনিটের ভাষণের পর পর বেগম জিয়ার ভাষনটি প্রচারিত হয়। এরপর মুহুর্তেই যেন বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে যায়। সেটি ছিল বেগম জিয়ার এক অসাধারণ ভাষণ। এতে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে কোন কথা বলেননি। জাতির সামনে বিএনপির অঙ্গীকারকেই বেগম খালেদা জিয়া তুলে ধরেছিলেন। অপরদিকে শেখ হাসিনার ভাষণটি ছিল আক্রমণাত্মক।

বেগম খালেদা জিয়া তার সেই নির্বাচনী ভাষণে স্বৈরশাসনের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, বিএনপি এক মুহুর্তের জন্যেও এরশাদের স্বৈরশাসনকে মেনে নেয়নি। গত ৯ বছর গুলি, টিয়ার গ্যাস ও সকল রকম হামলা এবং নির্যাতনের মুখে দাঁড়িয়ে জনগণের পাশে থেকে রাজপথে গ্রাম-গ্রামান্তরে আন্দোলন করেছে বিএনপি। ১৯৮৬ সালে এরশাদের অবৈধ সরকারের বৈধতা দিতে কেউ কেউ আঁতাতের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। আমরা সেই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। অঙ্গীকার করেছিলাম, অবৈধ দখলকারী এরশাদের অধীনে কোন নির্বাচনে যাব না, যাইনি। আমাদের কথায় আমরা ছিলাম অবিচল। স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পরই আমরা নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে যাচ্ছি। ১৯৮৬ সালের আঁতাতের নির্বাচনে যারা অংশগ্রহণ করেছিল তারাই এরশাদ সরকারের আয়ু দীর্ঘায়িত করেছিল। আজও তারা এরশাদ ও তার সহযোগীদের বিচারের দাবি করতে কুণ্ঠিত। কারণ, দুই  স্বৈরাচারী মহলেরই উৎস এবং স্বার্থ অভিন্ন। বিএনপি জনগণকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে। আমি আপনাদের সামনে অঙ্গীকার করতে পারি বিএনপি জয়ী হলে দুর্নীতিমুক্ত, সৎ ও গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করব। আমরা জনগণের আহার, শিক্ষা, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বাসস্থানের অঙ্গীকার করছি। আমাদের আরও অঙ্গীকার সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত এবং বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করব। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রামে বিএনপি প্রমাণ করেছে, আমরাই জনগণের বিশ্বস্ত বন্ধু। আমরা ২৫ বিঘা কৃষি উপকরণ সরবরাহ ও ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করণ, দিনমজুর ও শ্রমিকদের অবস্থার উন্নয়ন, চাকুরির বয়সসীমা ত্রিশ বছরে উন্নীত করার অঙ্গীকার করছি।

বেগম খালেদা জিয়া তার টেলিভিশন ভাষণে নারী ও শিশুদের সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে তার নীতির কথা বলেন। এর আগে শিশুদের ব্যাপারে কেউ কোন অঙ্গীকার করেননি। তিনি বলেন, দেশের নারী সমাজ আজ উপেক্ষিত এবং অবহেলিত। তারা দারিদ্রের শিকার, অশিক্ষার শিকার, নারী নিপিড়নের ঘটনা প্রায় প্রতিদিনকার খবর। অথচ নারীরা জনসংখ্যার অর্ধেক। শিক্ষা ক্ষেত্রে, চাকুরি ক্ষেত্রে, অর্থকরী কর্মের ক্ষেত্রে নারী সমাজ রয়েছে অনেক পিছিয়ে। তাদের সমান অধিকার সমাজে স্বীকৃত হয়নি। এই অবহেলিত নারী সমাজের মুক্তিসাধন করতে হলে তাদের জন্য শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা জরুরি। নারী মুক্তির জন্য তাই বিশেষ সঠিক কল্যাণ ও সমৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। নারী সমাজকে তাই উন্নয়ন কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করতে বিএনপি তাদের কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করছে। শিশুদের সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাদের সমাজে শিশুরা দারিদ্রের বড় শিকার। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিশু শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ পায় না। পায় না তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য। আদর পায়না, সমাজের মমতা পায়না। শৈশব থেকেই তারা অসহায় ভাসমান এবং ছিন্নমূল মানুষ। এই ছিন্নমূল শিশু-কিশোররাও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সংগ্রামে এক অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছে। তাদের চোখের স্বপ্ন একটি শান্তির নীড়, ভবিষ্যৎ, দুই বেলা ভাতের সংস্থান, আমরা অঙ্গীকার করছি, আমরা শিশুদের বিনোদন এবং ছিন্নমূল পুনর্বাসনের যথাসাধ্য চেষ্টা করব।

বক্তৃতা সর্বশেষে তিনি বলেন, ধানের শীষ সমৃদ্ধির প্রতীক, সৌন্দর্যের প্রতীক, অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতীক। নির্বাচনে ধানের শীষে ভোট দিন। অনেক পর্যবেক্ষকেই বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়ার এই টেলিভিশন বক্তৃতার পর অন্তত পক্ষে দশ শতাংশ ভোট দেন। আর মহিলাদের একচেটিয়া সমর্থন লাভ করেন বেগম খালেদা জিয়া। নির্বাচনের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা তার ছিল না। কিন্তু আকর্ষণীয় নানা কৌশল প্রয়োগ করে ’৯১-র নির্বাচনে চমক দেখান বেগম খালেদা জিয়া।

 

ঐতিহাসিক নির্বাচন এবং অভূতপূর্ব বিজয়

 

নির্বাচনী প্রচারণা শেষ করে বেগম খালেদা জিয়া ২৬ ফেব্রুয়ারী বিকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে এসেছিলেন সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করতে। তার চেহারার মধ্যে ছিল ক্লান্তিকর ছাপ। ঘুম নেই, খাওয়া নেই। ঠিকভাবে গোসল নেই। দীর্ঘ দুইমাস তিনি সারা বাংলাদেশে নির্বাচনী প্রচারে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তার শরীরের স্বাভাবিক ওজন অর্ধেক হয়ে যায়। স্বাস্থ্যও যায় ভেঙে।

 

প্রেসক্লাবে আসার পর শত শত সাংবাদিক তাকে ঘিরে ধরেছিল। নির্বাচনের ঠিক আগ মুহুর্তে নির্বাচন সম্পর্কে তার ধারনা কি, জানার জন্য। ইতিমধ্যে শেখ হাসিনা বলেছেন, নির্বাচনে তিনি দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ করবেন। সাংবাদিকদের তাই কৌতুহল ছিল বেগম খালেদা জিয়ার কি ভাবনা তা জানতে। কিন্তু বেগম জিয়া সাংবাদিকদের বললেন, দেখুন আমি সাংবাদিক সম্মেলন করতে আসিনি। শুধু আপনাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে এসেছি। আসলে এ কয়দিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। আজ ভাল লাগছে। তাছাড়া নির্বাচন সম্পর্কে আপনারাই তো ভাল জানেন। তারপরও একজন সাংবাদিক দাঁড়িয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করেন তার দল কয়টি আসনে বিজয়ী হতে পারে বলে তিনি আশা করছেন। এ প্রশ্নে তিনি হাসলেন। তাকে এ সময় মনে হয়েছে নিজের প্রতি তিনি খুবই কনফিডেন্ট। কয়টি আসনে তার দল বিজয়ী হবে বলে সে সম্পর্কে কোন সঠিক সংখ্যা না বলে তিনি বললেন, আগামীকাল সম্ভবত আপনারা একটা সারপ্রাইজ পাবেন। কি সারপ্রাইজ সেদিন কেউ তা বুঝতে পারলেন না। কারণ বিএনপির পক্ষ এবং বিপক্ষের প্রায় সব সাংবাদিকদেরই মোটামুটি একটা ধারণা জন্মেছিল যে, আসনের দিক থেকে আওয়ামী লীগই বেশী পাবে।

 

কিন্তু ২৭ ফেব্রুয়ারী সাংবাদিকরা আসলেই সারপ্রাইজ পেলেন, বেগম খালেদা জিয়ার দল নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হল। রাজধানী ঢাকা শহরে একটি আসনও আওয়ামী লীগ পেল না। শুধু রাজধানী নয়, ঢাকার আশপাশের সব আসনই বিএনপির দখলে এল। রাজধানীতে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার দুটি আসনেই ভরাডুবি হল। বেগম খালেদা জিয়া পাঁচটি আসনে দাঁড়িয়েছিলেন, পাঁচটিতেই বিপুল ভোটে বিজয়ী হলেন। আসলে দেশব্যাপী বিপুল জোয়ার নিজ চোখে দেখে তিনি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি বিজয়ী হবেন। তাই তিনি বলেছিলেন সেই সারপ্রাইজের কথা।

 

২৭ ফেব্রুয়ারী ’৯১ বেগম খালেদা জিয়ার জন্য এক অবিস্মরণীয় দিন। এদিনে তার নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। এত তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের বিজয়ই প্রমাণিত হয়। তাছাড়া ২৭ ফেব্রুয়ারী হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। একটি নিরপেক্ষ তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক আগ্রহ যেমনটা এবার দেখা গেছে, আগে তা দেখা যায়নি। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক গোষ্ঠীর মধ্যে ১২ সদস্যের কমনওয়েলথ দল, ৩০ সদস্যের সার্ক পর্যবেক্ষক দল, ব্রিটিশ শ্রমিক দলীয় প্রাক্তন মন্ত্রী পিটার শো’র নেতৃত্বে ব্রিটিশ পালামেন্টের ৪ সদস্যের দল, ওয়াশিংটনের একটি দলসহ অন্তত ৫৭ জন বিদেশী পর্যবেক্ষক বাংলাদেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন। তারা সবাই একবাক্যে বলেলেন, ওই নির্বাচন এত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে যে, উপমহাদেশের জন্য তা নতুন দৃষ্টান্ত। আসলে ৯ বছর স্থায়ী শাসনামলে কয়েকটি তথাকথিত নির্বাচনে দুর্নীতির অভিযোগ এতই ব্যাপক ছিল যে, যেসব কেলেংকারির অভিযোগ সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। এ নির্বাচন সম্পর্কে আগ্রহের সেটাই কারণ। নির্বাচনে দলের পক্ষে ভোট সংগ্রহের আশায় নেতা-নেত্রীরা দিবারাত্রী অসংখ্য নির্বাচনী সভায় ভাষণ দেন। এতে কণ্ঠস্বর অনেকেরই ভেঙে যায়।

 

নির্বাচনের দিন ভোটারদের কেন্দ্রে আগমন দেখে মনে হয়েছে এটাও বাংলাদেশের জাতীয় উৎসব। এত আনন্দ ঘন ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন হয়েছে যে, বাস্তবিকই অবাক হতে হয়েছেন। নারী-পুরুষ, তরুণ ও বৃদ্ধ ভোট কেন্দ্রে লম্বা লাইন ধরে সকাল থেকে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে ছিলেন তবুও তারা ভোট না দিয়ে কেউ ফেরেননি।

 

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ঢাকার বেতার স্টুডিওতে বিবিসির একটি পর্যালোচনা বৈঠক বসেছিল। বিবিসির সিরাজুর রহমান এটির পরিচালনা করে ছিলেন। এতে অংশ নিয়েছিলেন দিল্লির খ্যাতনামা পত্রিকার সম্পাদক ও বিশিষ্ট সাংবাদিক নিখিল চক্রবর্তী, ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদ ও প্রফেসর আনিসুজ্জামান। নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য প্রসঙ্গে সাংবাদিক নিখিল চক্রবর্তী বলেন, ’৪৮ বছর ধরে রিপোর্ট করছি। ১৯৪৫ থেকে আজ অবধি ১১টি ইলেকশন কভারেজ করেছি রিপোর্টার হিসেবে। কোন ইলেকশন এত সুষ্ঠু হতে দেখেনি; এরকম জনসাধারনের পাটিসিপেশন। তারমধ্যে গোলমাল নেই, টেনশন নেই- এ আমি আগে দেখেনি। ব্যারিস্টার ইশতিয়াক মন্তব্য করেন-২৭ফেব্রুয়ারী আমাদের জাতীয় জীবনের ঐতিহাসিক দিন। এত সুন্দর নির্বাচন হয়েছে যে, এ নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশের মানুষ আত্মত্যাগ করেছে। প্রফেসর আনিসুজ্জামান বলেন, এ নির্বাচনে মানুষের আস্থা ফিরেছে। নির্বাচনের দিন নিজ কেন্দ্রে ভোট দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ৯বছর পর মুক্ত পরিবেশে ভোট দিয়েছি। শেখ হাসিনা বলেন, দীর্ঘ দিন পর মুক্ত পরিবেশে ভোট দিয়েছি। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ বলেন, ভোট দিতে পেরে খুশি হয়েছি।

 

এ অবিস্মরণীয় নির্বাচনে বিজয়ী হলেন বেগম খালেদা জিয়া ও তার দল বিএনপি। জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে বিএনপি ১৪৪টি এবং আওয়ামী লীগ ৮৪টি আসন লাভ করে। বিএনপির প্রতি জামায়াতের সমর্থন ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে সংসদের সংরক্ষিত ৩০টি মহিলা আসনের মধ্যে ২৮টি বিএনপি ও ২টি জামায়াত লাভ করে। সংসদের বাকি আসনগুলো পায় অন্যান্য দল। নির্বাচনে খালেদা জিয়ার বিপুল বিজয় সম্পর্কে বিবিসির মন্তব্য হচ্ছে, জেনারেল এরশাদের স্বৈরতন্ত্রী সরকারের বিরুদ্ধে বেগম খালেদা জিয়া এবং বিএনপির আপোসহীন আন্দোলনের বিশেষ করে তরুণ ভোটদাতাদের মনে বেশী রেখাপাত করেছিল। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে শেখ হাসিনার ভূমিকা সেরকম ছিলনা। ’৭১-এর শিক্ষার উপর গুরুত্ব না দিয়ে মুজিব হত্যার দিকটাকে বড় করে তুলে ধরেছিলেন শেখ হাসিনা। বিবিসির মন্তব্যে আরও বলা হয়, যে মহিলাদের ভোট ব্যাপকভাবে বেগম খালেদা জিয়াকে আনুকূল্য দেখিয়েছে।

 

নির্বাচনে বিএনপি ও খালেদা জিয়ার বিজয়ের কারণ ছিল অনেকগুলো। এরমধ্যে রয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি ও জনপ্রিয়তা। আন্দোলনে তার আপোসহীন দৃঢ় মনোভাব, স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের কারণগুলোর সঠিক মূল্যায়ন, ছাত্র ও মহিলাদের মধ্যে দলটির ব্যাপক জনপ্রিয়তা। নির্বাচনী প্রচারণায় বর্তমান জাতীয় ইস্যুগুলো তুলে ধরার প্রয়াস, বিএনপির শাসনামলে স্বর্ণযুগ হিসাবে বর্ণনার সাফল্য ইত্যাদি। বেগম খালেদা নেতিবাচক ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য থেকে বিরত ছিলেন। বিএনপির অঙ্গীকার ব্যাপক জনগণের মধ্যে তুলে ধরার জন্য বেগম খালেদা জিয়া আয়োজন করেছেন অসংখ্য জনসভার। যেখানেই তিনি গিয়েছেন, জনতার ঢল উপছে পড়েছে। বিভিন্ন জনসভায় বেগম খালেদা জিয়া স্পষ্টভাবে বলেছেন, কোন ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে বিএনপি বিশ্বাস করে না। আমরা জনগণের কাছে পরিষ্কার থাকতে চাই। জনগণ এ বক্তব্য পর্যালোচনা করে এর সত্যতা পেয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির নেতৃত্বে এসেছিলেন দলের ভাঙন রোধের জন্য তিনি ভাঙন রোধ করে দলকে সংগঠিত করেছেন। বেগম জিয়া তার স্বামী জিয়াউর রহমানের বিশাল ব্যক্তিত্বকে ধারণ করতে সক্ষম হন। এবং বিরোধী অবস্থান থেকে বিএনপিকে নিয়ে যান জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তাকে জাতীয়তাবাদী শক্তির ঐক্যের প্রতীক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ফলে তার ও তার দলের বিজয় অভাবিত নয়।

 

 

বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী

 

১৯ মার্চ। ১৯৯১সাল। জননন্দিত নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জীবনে এক অবিস্মরণীয় সাফল্যের দিন। একদা যিনি ছিলেন একজন সাধারণ গৃহবধু তিনিই হলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। এদিন ঠিক সন্ধ্যায় সরকারিভাবে ঘোষণা করা হল তার প্রধানমন্ত্রী হবার খবর। বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবিভূত হলেন। এদিন থেকেই শুরু হল তার রাষ্ট্রীয় কর্মজীবন। এতদিন রাজপথে যিনি দুর্বার সংগ্রাম করেছেন, তিনি আজ এসেছেন রাষ্ট্র ক্ষমতায়। এসেছেন দেশ পরিচালনার দায়িত্বে। অপরদিকে যে মহিলারা এক সময় অন্তঃপুরবাসিনী ছিলেন, চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং রাজনীতি তো দূরের কথা সাধারণভাবে ঘরের বাইরে আসতে পারতেন না, আজ তাদেরই একজন প্রতিনিধি এসেছেন রাষ্ট্র ক্ষমতায়। বাংলাদেশের জন্য এক নতুন ইতিহাস।

 

১৯মার্চ ১৯৯১। সন্ধ্যায় বেগম খালেদা জিয়া ড্রয়িং রুমে বসে কয়েকজন অতিথির সঙ্গে কথা বলছিলেন।  অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ তাকে প্রধানমন্ত্রী করে ১১জন কেবিনেট মন্ত্রী ও ২১জন প্রতিমন্ত্রী নিয়ে মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেছেন। তার চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

 

ড্রয়িং রুম থেকে উঠে তিনি পাশের রুমে গেলেন মায়ের কাছে। পা ছুঁয়ে মাকে সালাম করলেন। মা বুকে জড়িয়ে ধরে দোয়া করলেন মেয়েকে। বড় ছেলে তারেক রহমান পিনো বাসার বাইরে ছিলেন। বাইরে থেকেই শুনেছেন মায়ের প্রধানমন্ত্রী হবার খবর। এরপর কাজ সংক্ষিপ্ত করে ছুটে এলন বাসায়। মাকে সালাম করলেন। একগুচ্ছ রজনীগন্ধা ও গোলাপ দিয়ে অভিনন্দন জানালেন। নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বুকে জড়িয়ে ধরলেন ছেলেকে। আদর করলেন। এরপর দলীয় নেতাকর্মী ও শুভাকাক্সিক্ষরা দলে দলে এসে ফুল দিয়ে অভিনন্দন জানালো নতুন প্রধানমন্ত্রীকে।

 

২০মার্চ ১৯৯১। বেগম খালেদা জিয়া তার মন্ত্রীদের নিয়ে বঙ্গভবনে শপথ নিলেন। শপথ করলেন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ। এদিন তার পরনে ছিল সাদার মধ্যে সাদা করা জামদানি শাড়ি। শপথ অনুষ্ঠান শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকরা ছেকে ধরেন বাংলাদেশের প্রথম ও বিশ্বের অষ্টম মহিলা প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে। তিনি দাঁড়িয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। তিনি বলেন, নির্বাচনের সময় জনগণকে দেয়া সকল ওয়াদা পূরণে তিনি সচেষ্ট থাকবেন। জেনারেল এরশাদ সম্পর্কে নতুন প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, তার বিচার অবশ্যই হবে। এ বিচার চলছে। কয়েকটি মামলায় সাজা পেয়ে জেনারেল এরশাদ তা ভোগ করছেন। গণতন্ত্রকে সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তিনি সর্ব রাজনৈতিক দল ও সর্বমহলের সাহায্য কামনা করেন। বেগম খালেদা জিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম কাজ হবে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের মত জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ, দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং অবকাঠামো নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা উল্লেখ করে তিনি দুর্নীতিমুক্ত সরকার কায়েমের কথাও ঘোষণা করেন।

 

সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা শেষ করেই বেগম খালেদা জিয়া বঙ্গভবনের দরবার হল থেকে বেরিয়ে আসেন এবং তার নিজস্ব জিপে মা তৈয়বা মজুমদার, বড় ছেলে পিনো, দুই ভাই, দুইভ্রাতৃ বধূকে নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, শহীদ জিয়ার মাজার ও জাতীয় স্মৃতিসৌধের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। প্রধানমন্ত্রীর জন্য জাতীয় পতাকা শোভিত গাড়ি তৈরি করা হলেও তিনি সে গাড়ি ব্যবহার করেননি। ফলে তার জীপেই জাতীয় পতাকা লাগিয়ে দেয়া হয়।

 

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের দিনটি ছিল বেগম খালেদা জিয়ার একটি ব্যস্ত দিন। তখন ছিল রমজান মাস। সেহরি খাবারের পর মাত্র তিন ঘন্টা ঘুমান। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ভক্তদের সাক্ষাত দেন। ফুলের তোড়া নিয়ে তাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য অপেক্ষা করছিল শত শত ভক্ত। তার টেলিফোনটি ঐদিন এক সেকেন্ডের জন্য অসর ছিল না। দুপুর দুটা পর্যন্ত ভক্তদের সাক্ষাতদান ছাড়াও শপথ নিতে বঙ্গভবনে যাবার প্রস্তুতি নেন। এরপর তিনি বিকাল তিনটায় বঙ্গভবনে যান শপত নিতে। শপথ শেষে শহীদ মিনার, শহীদ জিয়ার মাজার ও স্মৃতি সৌধে শ্রদ্ধা জানিয়ে সন্ধ্যায় তিনি  ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দরের বাসায় এসে ইফতার করেন। রাত আটটায় বিএনপির বনানী কার্যালয়ে গেলে সৃষ্টি হয় এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের। পুরো রাস্তা লোকেলোকারণ্য হয়ে পড়েছে। তার গাড়ি আসতেই দুলাইনে দাঁড়িয়ে থাকা জনতা ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে তাকে অভিনন্দন জানায়। রাত দশটার পর তিনি দলীয় নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাতে মিলিত হন। রাতে বাসায় ফিরে তিনি ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে টেলিফোনে কথা বলেন।  রোজা ও প্রচন্ড ব্যস্ততায় তাকে খুব ক্লান্ত মনে হয়েছিল। তবে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গেই কাটে তার প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রথম দিন। ৭ মার্চ ১৯৯১। তিনি যান সিলেটে হয়রত শাহজালাল (রঃ) মাজার জিয়ারত করতে। বিয়ের পর স্বামী জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তিনি কয়েকবার এ মাজার জিয়ারত করেন। তিনি হয়রত শাহজালাল (রঃ) মাজার জিয়ারত করেই তার নির্বাচনী প্রচারণাও শুরু করেছিলেন।

 

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর খালেদা জিয়া হয়ে উঠেন দেশের রাজনৈতিক গতিধারার কেন্দ্রবিন্দু। প্রধানমন্ত্রীত্বের ১২তম দিন ১ এপ্রিল ’৯১ মন্ত্রী পরিষদের বৈঠকে বেগম জিয়া নিজেই সভাপতিত্ব করেন। ক্রমেই তিনি হয়ে উঠেন সরকারের মূখ্য ব্যক্তিত্ব। অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট গণঅভ্যুন্থানের ইমেজে নির্মিত জনমতের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত মন্ত্রিসভায় তাকে সভাপতিত্ব করার সুযোগ দেন। অবশ্য মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকটিতে সভাপতিত্ব করেন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ। খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রীত্ব শুরু হয়  একটি বিশাল স্বপ্নের মধ্য দিয়ে। খালেদা জিয়া নিজেকে উপলব্ধি করেন নতুন ভূমিকায়। কথা ও কাজে অভিন্ন থাকার যে ইমেজ খালেদা জিয়া বিরোধী রাজনৈতিক নেত্রী থাকায় গড়ে তুলেছিলেন, সরকার গঠনের পরও তিনি তা বজায় রাখবেন বলে ঘোষণা দেন। ৪ এপ্রিল ’৯১ অনুষ্ঠিত তার সভাপতিত্বে মন্ত্রীপরিষদের বিশেষ বৈঠকে ১৫ এপ্রিল ’৯১ থেকে ২৫ বিঘা পর্যন্ত খাজনা মওকুফ করা, পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত কৃষি ঋণ মওকুফ করা এবং সরকারী চাকরীতে যোগ দেয়ার সময়সীমা ২৭ থেকে বৃদ্ধি করে ৩০ বছর করার সিন্ধান্ত নেয়া হল। মন্ত্রী পরিষদ এসব কৃষিঋণ সংক্রান্ত সার্টিফিকেট মামলাও স্থগিত রাখার সিন্ধান্ত নেয় এর মাধ্যমে তিনি নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ করতে শুরু করলেন। ৫ এপ্রিল ’৯১ জাতীয় সংসদের অধিবেশন শুরু হল। এটা ছিল তার জীবনে নতুন এক অভিজ্ঞতা। প্রধানমন্ত্রী  হিসেবে খালেদা জিয়া সচল সক্রিয় হয়ে ওটেন জাতির এক দুর্ভাগ্যজনক সময়ে। প্রধানমন্ত্রীত্বের ৩৯ দিনের মাথায় ২৯ এপ্রিল শতাব্দীর অন্যতম প্রলয়ংকারী ঘূণিঝড় আঘাত হানে বাংলাদেশে। সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল উপকূলীয় এলাকা ধ্বংষস্তুপে পরিণত হয়। চট্রগ্রাম পার্বত্য চট্রগ্রামের জনপদই বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছাসে লক্ষাধিক লোকের মৃত্যু ঘটেছে, বিনষ্ট হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। এ ধরনের দুযোগ্যের জন্য নুন্যতম প্রস্তুতিও ছিলনা। নবীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তার মন্ত্রীসভাকে নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলায় ঝাপিয়ে পড়েন। তার নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের ত্রাণ সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়। মানুষকে বাঁচানোর ত্রান তৎপরতার সঙ্গে তিনি রাজনীতিকে যুক্ত করেননি। ত্রান তৎপরতাকে তিনি দল ও রাজনীতির উর্ধ্বে স্থান দিলেন। তার তৎপরতা ছিল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, বিএনপির চেয়ারপার্সন হিসেবে নয়। তিনি সরকারকে সহযোগিতা করতে, বাংলাদেশের বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়াতে আন্তর্জাতিক সাহায্যের আবেদন জানালেন। পেলেন ব্যাপক সাড়া। খালেদা জিয়া ৬ মে থেকে  ৯ মে ’৯১ চট্টগ্রামে অবস্থান করে ত্রাণ তৎপরতার তদারকি করেন। এ কয়দিন তার দফতর সেখানে স্থানান্তরিত হয়। প্রতিটি থানার জন্য মন্ত্রী নিয়োগ করেন, এমপিদের দায়িত্ব দেন। উপকূলীয় লোকদের বাঁচাতে বেগম খালেদা জিয়ার আহবানে সাড়া দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের নির্দেশে একটি টাস্কফোর্স আসে বাংলাদেশে। পরিস্থিতি কিছু দিনের মধ্যেই নিয়ন্ত্রণে আসে। ত্রাণ তৎপরতায় খালেদা জিয়ার সবচেয়ে বড় সাফল্য, এবারই প্রথম বাংলাদেশে কোন দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরাও কোন অভিযোগ করেনি। সফলভাবেই তিনি ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেন।

 

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাঁচ মাসের মাথায় খালেদা জিয়ার আরেকটি বড় ধরনের সাফল্যে সবাইকে চমৎকৃত করে। তা হচ্ছে দেশের শাসন পদ্ধতি কি হবে তিনি তা ঠিক করতে পেরেছেন। প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির ভাবধারায় তার দল বিএনপি গড়ে উঠলেও তিনি সরকারে আসার আগে বার বার বলেছেন, সরকার পদ্ধতি কি হবে তা ঠিক হবে নির্বাচিত সংসদে। জনগণ যে পদ্ধতি ভাল মনে করেন, সেই পদ্ধতিতেই দেশ চলবে। ১৯৯১-র ঐতিহাসিক সংসদ নির্বাচন হলে দেখা যায় অধিকাংশ সদস্যই চাচ্ছেন সংসদীয় সরকার পদ্ধতি। তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের সাথে ব্যাপক মতবিনিময়ের পর সিদ্ধান্ত নিলেন,সংসদীয় পদ্ধতি যেহেতু সবার কাম্য, সংসদীয় পদ্ধতিতেই দেশ চলবে। ২এপ্রিল জাতীয় সংসদে সংসদ নেত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সংসদীয় সরকার পদ্ধতির পক্ষে ঐতিহাসিক বিল আনেন। একই সঙ্গে আনলেন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের স্বপদে ফিরে যাওয়া সংক্রান্ত একাদশ সংশোধনী বিল। সংসদে এ সম্পর্কে এক বিবৃতিতে তিনি বললেন, আমরা এমন সংসদীয় পদ্ধতি চাই, যা জনগণের কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না তার পদক্ষেপকে সাহসী আখ্যায়িত করে বিরোধী নেতারা সেদিন বেগম জিয়ার প্রশংসা করেন। এবং তাকে অভিনন্দিত করেন। বিলটি বাছাই কমিটিতে পাঠানো হয়। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ এবং ওয়ার্কাস পার্টির নেতা রাশেদ খান মেননও সংসদীয় পদ্ধতির পক্ষে বিল আনেন। সবগুলো বিল বাছাই কমিটিতে পাঠানো হয়। বাছাই কমিটিতে সংশোধন, সংযোজন করে সকল রাজনৈতিক দলের ঐক্যমতের ভিত্তিতে সংবিধানের একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনী বিল দুটি ২৮ জুলাই সংসদে ফেরত পাঠানো হয়। এর উপর অনুষ্ঠিত হয় দীর্ঘ আলোচনা। অবশেষে ৬ আগস্ট সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে সর্বসম্মতভাবে পাস হয় সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী বিল। একই সঙ্গে পাস হয় অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের পূর্ব পদে ফিরে যাওয়া সংক্রান্ত একাদশ সংশোধনী বিল। দ্বাদশ সংশোধনী বিলটি পাশ হয় ৩০৭-০ ভোটে এবং একাদশ সংশোধনী বিলটি ২৭৮ ভোটে।

 

দীর্ঘ সাড়ে ষোল বছরের প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে দেশকে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরিয়ে নেয়ার ঐতিহাসিক মুহূর্তটি ছিল বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে অভূতপূর্ব। এ ছিল এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। আন্তরিকতা, সততা ও দূরদর্শিতার জন্য বেগম খালেদা জিয়া আবার বিজয়ী হলেন। গণভোট অনুষ্ঠান করে দেশে সংসদীয়  পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা হয়। বেগম খালেদা জিয়া ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ দেশের সরকার প্রধান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন। সবচেয়ে বড় কথা বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বেই এ দেশের শাসনতন্ত্রের মৌলিক কাঠামোগত রদবদল হলো বেগম খালেদা জিয়া বলতেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়। সংসদীয় গণতন্ত্রের উত্তরণ করে তিনি তা এই বিশ্বাসকে সবার সামনে প্রমাণ করেন। এরপর দেশ ও দেশের মানুষের উন্নতির লক্ষ্যে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়ে বেগম খালেদা জিয়া এগিয়ে যাচ্ছেন। দেশ এখন সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে।

 

 

প্রধানমন্ত্রীত্বের পাঁচ বছর (১৯৯১-৯৬)

 

দেশ পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া পাঁচ বছর পূর্ণ করেছেন। ১৯৯১ সালে একটি বিপর্যস্ত আর্থ-সামজিক পরিস্থিতির বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দীর্ঘ নয় বছরের স্বৈরাচারী শাসনের ফলে তখন দেশের অর্থনীতি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। অরাজকতা, সন্ত্রাস আর সেশনজটে মুখ থুবড়ে পড়েছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কৃষক-শ্রমিক সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। স্বৈরাচারের লুণ্ঠনে রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূন্য হয়ে পড়েছিল। ব্যাংকিং সেক্টর হয়ে পড়েছিল দেওলিয়া। মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে চলে গিয়েছিল নিয়ন্ত্রণের বাইরে সবরকম সামজিক  মূল্যবোধ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হয়ে পড়েছিল অস্তিত্বহীন। এই অবস্থার মধ্যে একটি নিয়ম-শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করা ছিল বাস্তবিকই কষ্টসাধ্য। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া সফল হয়েছেন।

 

মানুষের অকুণ্ঠ ভালবাসা আর দৃঢ় মনোবলকে পুঁজি হিসেবে নিয়ে বেগম খালেদা জিয়া পাঁচ বছর আগে শূন্য অবস্থান থেকে শুরু করেছিলেন তার যাত্রা। পাঁচ বছর পর তার শাসনকাল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, যে আশা নিয়ে এ দেশের সাধারণ মানুষ তাকে নির্বাচিত করেছিল, সেই আশা তিনি অনেকখানি পূরণ করতে পেরেছেন। এসময়ে মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক আকাঙ্খাগুলো পূরণ হতে শুরু করে। বাংলাদেশে এমন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিরাজ করেছে, যা এ দেশের মানুষ ইতিপূর্বে কখনো প্রত্যক্ষ করেনি। বাক, ব্যক্তি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা অবারিত। গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ সংবাদপত্র ভোগ করে নিরংকুশ স্বাধীনতা। সারাদেশে শত শত দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সংবাদপত্রের পাতায় সরকারের বিরুদ্ধে এমন কোন সমালোচনা নেই যা ছাপানো হয় না। একদম কোন কথা নেই যা বলা হয় না। বিচার ব্যবস্থা কাজ করছে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে। ফলে আদালতের মাধ্যমে জনগণের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়েছে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর মাধ্যমে জনগণের ন্যায় বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়েছে। সংসদীয় কমিটিগুলোর মাধ্যমে প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়েছে। স্থানীয় সরকারগুলো পরিচালিত হয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে। স্বৈরাচারের হাতে ভেঙে-পড়া অর্থনৈতিককাঠামো পুনরায় গড়ে তুলতে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া রাত দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। স্বৈরশাসনের নয় বছরে যে দারিদ্রক্লিষ্ট ও অসহায় বাংলাদেশেরচিত্র বিশ্ববাসী এতোদিন বদনার সাথে প্রত্যক্ষ করতো, বেগম খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের পরিশ্রমের ফলে যে অবস্থা এখন আর নেই, গণতন্ত্রায়ন, অর্থনৈতিক সংস্কার, ব্যক্তি উদ্যোগের প্রাধান্য, বাজার অর্থনীতি প্রবর্তন, আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, অবকাঠামো নির্মাণ, আত্মকর্মসংস্থান প্রকল্পজোরদার, শিল্পায়ন, বিনিয়োগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাস্তব পদক্ষেপ নেয়ার ফলে বিশ্ববাসীর কাছে  বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার এক বিকাশমান অর্থনীতির দেশে হিসাবে বিবেচিত হয়। যে বিদেশীরা একদিন বাংলাদেশকে বলতো তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ তারাই বাংলাদেশকে বলেছে দি ইমাজিং টাইগার। বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলো আজ তাদের পুঁজি বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশকে বেছে নিচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। শিল্প পণ্যের বাজার বিস্তৃত হচ্ছে নিভূত পল্লীতেও। ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ফলে বাড়ছে কর্মসংস্থান। ওই পাঁচ বছরে বাংলাদেশের যে উন্নতি হয়েছে, তা স্বাধীনতার ২০ বছরেও হয়নি।

 

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে জোরদার করা এবং সমাজের সকল স্তরে গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা ছিল প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক অঙ্গীকার। সেই অঙ্গীকার পুরনে তিনি একের পর এক উদাহরণ সৃষ্টি করে যান। বিএনপি প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার সমর্থক ছিল। কিন্তু নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, সরকার পদ্ধতির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচিত সংসদ। নির্বাচনের পর সংসদ সদস্যদের মতামতকে সম্মান জানিয়ে তিনি সংসদীয় সরকার পদ্ধতিই গ্রহণ করেন। দেশের সকল পর্যায়ে জনগণের ইচ্ছাই সর্বোচ্চ মর্যাদা পায় ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা এবং উপ-নির্বাচন হয়েছে অবাধ ও নিরপেক্ষ। এর কোথাও জয়ী হয়েছেন সরকারি দল, কোথাও বা বিরোধী দল। আর জনগণের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে এই উপমাহাদেশে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াই নতুন নজির স্থাপন করেন সিটি কর্পোরেশনগুলোতে। এ সময়ই প্রথম নাগরিকরা সরাসরি ভোট দিয়ে তাদের পছন্দ মাফিক মেয়র ও কমিশনার নির্বাচিত করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় এই দৃষ্টান্ত বিরল। শুধু তাই নয়, চারটি সিটি কর্পোরেশনের পূর্ব মেয়র ছিলেন, তাদেরকে নির্বাচনের আগে তাদেরকে মেয়র পদ থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বেগম খালেদা জিয়ার দল ঢাকা ও চট্টগ্রামে হেরে যায়। জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য স্বতন্ত্র সংসদ সচিবালয় বিল পাস হয়েছে এ সময়।

 

দেশ পরিচালনায় বিরোধী দলের অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করার জন্য সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যদের সমন্বয়ে ৬০টির মত সংসদীয় কমিটি গঠিত হয়। এর মধ্যে প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়।

 

স্বৈরশাসক এরশাদের দুর্নীতি ও অনিয়মে ভেঙ্গে পড়া প্রশাসন, অর্থনীতি, বিচারব্যবস্থা, সমাজনীতিসহ সর্বক্ষেত্রে ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছিল। বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে এসব ভঙ্গুর পরিস্থিতি থেকে দেশেকে উত্তরণের নানা পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন। এসময় তিনি বিএনপিকেও শক্তিশালী করার উদ্যাগ নেন। ১৯৯৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর দলের চতুর্থ কাউন্সিল অনুষ্ঠান করেন।

 

প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া নির্বচন প্রক্রিয়াকে অধিকতর সুষ্ঠু ও অবাধ করার লক্ষ্যে আরেকটি সাহসী পদক্ষেপ নেন সেটি হলো জাতীয় সংসদ গণপ্রতিনিধিত্ব (সংশোধন)। বিল ’৯৪ এবং ভোটার তালিকা (সংশোধন) বিল ’৯৪ পাস হয়। এই বিল দুটি পাসের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনই সর্বোচ্চ ক্ষতার অধিকারী। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোন দল, ব্যক্তি বা প্রশাসনের প্রভাব বিস্তারের আর বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। এ  ছাড়া নির্বাচনকে জাল ভোট মুক্ত করার লক্ষে ভোটাদের পরিচয়পত্র দেয়ার সিদ্ধান্তের ফলে সকল নাগরিক তাদের নিজের ভোট নিজেরাই দেয়ার নিশ্চয়তা পান। পরিচয়পত্র ব্যবস্থা চালু করার জন্য প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সরকার প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন। গণতন্ত্রের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আরেকটি নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। সেটি হলো বিরোধী দল সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট নিরসনের লক্ষ্যে সাধারণ নির্বাচনের  ৩০ দিন আগে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) ও তার মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করবেন। এ ক্ষেত্রে তিনি বিরোধী দলের কাছে বর্তমান সরকারের মেয়াদকাল পর্যন্ত দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে হরতাল অবরোধের মতো কর্মসূচি পরিহার করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার এসব দুরদর্শী পদক্ষেপের ফলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত হবার কথা। স্বৈরশাসনামলে যেখানে সংসদ, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, সংবাদপত্র, নির্বাহী বিভাগ প্রভৃতি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, আজ সেসব প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি মজবুত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে সরকারে এসে দেশের জন্য যে উদার অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করেন, এর ফলে বর্তমানে বাংলাদেশে তার ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘতম সামাজিক ও অর্থনৈকি স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হযেছে। অর্থনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু করা। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই প্রথম বাজার অর্থনীতি গ্রহণের সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এখন এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশও বাংলাদেশকে অনুসরণ করছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজার অর্থনীতি প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত মেধা ও উদ্যোগের বিকাশের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এখন বলছেন, অর্থনীতিতে যে গতি সঞ্চারিত হয়েছে, অব্যাহত থাকলে এই দেশকের শেষ নাগাদ বালাদেশের জন্য হয়তো আর বিদেশী সাহায্যের প্রয়োজন হবে না। এরই মধ্যে বাংলাদেশ বিদেশ-নির্ভরতা অনেকখানি কাটিয়ে উঠেছে। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে দেশের উন্নয়ন বাজেটে নিজস্ব সম্পদের যোগান হচ্ছে প্রায় ৪৩ শতাংশ। ১৯৯০ সালে যা ছিল শুণ্যেরও নিচে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকায়। বাংলাদেশে এটা সর্বকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড। অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং রাজস্ব ও মুদ্রানীতির সংস্কারের ফলে মুদ্রাস্থীতির হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে ১৯৯০-৯১ সালে মুদ্রাস্ফতি ছিল শতকরা ৯ ভাগ, তা ১৯৯৩-৯৪ সালে হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১.৮ভাগে। একইভাবে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হারও অব্যাহত রয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার শতকরা ৫ ভাগে উন্নীত হয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে আশার সঞ্চার করেছে। বিভিন্ন রফতানিমুখী শিল্প উদ্যোগে উৎসাহ দানের ফলে দেশের রফতানি আয় বছরে তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের স্টক এক্সচেঞ্জ পুঁজি বাজারে এ সময় অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করে। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসার পর পাঁচটি বাজেট হয়েছে। প্রতিটি বাজেটই হয়েছে গণমুখী। ১৯৮৯-৯০ সালে যেখানে জাতীয় বাজেট ছিল সর্বমোট ৫ হাজার ১০৩ কোটি টাকা, সেখানে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সরকারের দেয়া  ১৯৯৫-৯৬ সালের জাতীয় উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ দ্বিগুণেরও বেশি। খালেদা জিয়ার সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বৈদেশিক সাহায্য ও নির্ভরশীলতা হ্রাস করে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে অভ্যন্তরীণ সম্পদের পরিমাণবৃদ্ধি করার নীতি গ্রহণ করে। সে নীতি সফল হয়। ১৯৯০-৯১সালে অভ্যন্তরীণ সম্পদের পরিমাণ ছিল মাত্র ৭৯১ কোট টাকা। ১৯৯৫-৯৬ সালে তা ৪ হাজার ৮শ’ ৭৭ কোটি টাকায় বৃদ্ধি পায়। কাজের বিনিময়ে খাদ্য, ভিজিডি, জিআর, টিআর, কর্মসূচির মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থানের জন্য ১৯৯৫-৯৬ সালে ১ হাজার ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। ওই সময় নগর ও গ্রামাঞ্চলে সড়ক ও সেতু নির্মাণে বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল। এসব উন্নয়নমূলক কাজে প্রতিবছর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ১০ লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

 

প্রধানমনন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সফল নেতৃত্বে পাঁচ বছর বাংলাদেশের অতুলনীয় উন্নয়ন ধারা সূচিত হয়। তবে এ ক্ষেত্রে তিনি প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের কাছ থেকে সহযোগিতার বদলে রাজনৈতিক বিরোধিতাই পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ ১৭৩দিন হরতাল পালনসহ নানাভাবে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বাধার সৃষ্টি করে। পুনঃপুনঃ বন্যা, খরা, সাইক্লোন, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বসও উন্নয়ন প্রয়াসকে বাধাগ্রস্থ করেছে।

 

প্রধানমন্ত্রীত্বের পাঁচ বছরে বেগম খালেদা জিয়া সরকারের সাফল্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল:

 

আইন-শৃঙ্খলা

 

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সাধন করে সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা অর্জন করা হয়। দেশে সন্ত্রাস, খুন রাহাজানি, ধর্ষণ ইত্যাদি মারাত্মক অপরাধ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায় এবং জনজীবনে স্বস্তি ফিরে আসে।

 

 

সংসদীয় পদ্ধতি

 

জাতীয় সংসদে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী পাসের মাধ্যমে দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়। দেশ পরিচালনায় বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বিরোধী দলের সদস্যদের সমন্বয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিসমূহ গঠন করা হয়।

 

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা

 

সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাশের মাধ্যমে সকল সাধারণ নির্বাচনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক ধারবাহিকতা রক্ষা করে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়।

 

মেয়র নির্বাচন

 

সকল পৌর কর্পোরেশনে প্রত্যক্ষ ভোটে মেয়র নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। দেশের প্রথমবারের মত প্রত্যক্ষ ভোটে মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

 

 

ভোটার পরিচয়পত্র

 

নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য প্রত্যেক ভোটারকে পরিচয়পত্র প্রদানের জন্য সংসদে বিল পাস এবং এজন্যে প্রায় ৩০০কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়।

 

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও অবাধ তথ্য প্রবাহ: সংবাদপত্র ও সংবাদ প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়। এই সময়ে দেশে প্রথমবারের মতো অনেকগুলো জাতীয় স্থানীয় পর্যায়ে পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়। বিবিসি, সিএনএন ও স্যাটেলাইট টিভি অনুষ্ঠান প্রচারের অনুমতি দেয়ার মাধ্যমে অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা হয়। রাঙ্গামাটি ও কক্সবাজারে রেডিও স্টেশন প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়।

 

অর্থনেতিক, সামাজিক ও কল্যাণমূলক উন্নয়ন বাজেট

 

১৯৮৯-৯০ সালের শতকরা প্রায় ১০০ ভাগ বিদেশী ঋণনির্ভর ৫ হাজার ১০০ কেটি টাকার উন্নয়ন বাজেট থেকে ১৯৯৫-৯৬ সালে ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেটে প্রণয়ন করা হয়, যার ৪৩ ভাগ অর্থ নিজস্ব সম্পদ থেকে যোগান দেয়া হয়। উল্লেখ্য, বিএনপি ক্ষমতা লাভের পূর্বে উন্নয়ন বাজেটগুলোতে নিজস্ব সম্পদের যোগান ছিল শতকরা ২ থেকে ৩ ভাগ।

 

মুদ্রাষ্ফীতি

মুদ্রাস্ফীতির গড় ৩% এর নিচে রাখা হয়।

 

 

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও টাকার মান

 

১৯৯৫ সালের ৩০ জুন বিএনপি সরকারের আমলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা একটি সর্বকালীন রেকর্ড ১৯৯৬ সারের ৩০ মার্চ বিএনিপ সরকারের ক্ষমতা ত্যাগের পূর্বে বিরোধী দল কর্তৃক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে একটা নানাবিধ বাধা সৃষ্টি করা সত্ত্বেও এই মজুদের পরিমাণ ছিল প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ডলারের মতো। ১৯৯৫-৯৬ সালে টাকার গড় বিনিময় হার ছিল ১ মর্কিন ডলার ৪০.২০ টাকা।

 

 

শিল্প-বাণিজ্যে দেশেী-বিদেশী বিনিয়োগ

 

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রেখে ও বিদ্যুৎ, টেলিফোন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করে কৃষি, শিল্প, পরিবহণ, যোগযোগ, বিদ্যুৎ ও গ্যাসসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। এভাবে দেশে প্রথমবারের মতো ব্যাপক বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ফলপ্রসূ উদ্যোগ নেয়া হয়। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত এবং নতুন কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে সকল নতুন শিল্পকে প্রথম পাঁচ বছরের জন্য ট্যাক্স হলিডে মঞ্জুর করা হয়।

 

কৃষি, সমবায়, কৃষক ও তাঁতী

 

কৃষকদের জন্য পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত কৃষিঋণ মওকুপ করা হয়। এ বাবদ মোট কৃষিঋণ মওকুফের  পরিমাণ ছিল পায় আড়াইহাজার কোটি টাকা।

তাঁতী ও সমবায়ীদের ঋণের সুদ ও দন্ডসুদ মওকুফের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় কিন্তু পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার আমলে তা বাস্তবায়িত হয়নি। কৃষকদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করা হয়। কৃষকদের মাঝে সহজ শর্তে কৃষিঋণ বিতরণ পদ্ধতি চালু করা হয়। কৃষি ও সেচ কাজের সুবিধার্থে সার, বীজ, কীটনাশক, ডিজেল, সেচপাম্পসহ যাবতীয় কৃষি উপকরণের মূল্য হ্রাস করে কৃষকদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখা হয়। নদী ভাঙনের পর ৩০ বছরের মধ্যে লুপ্ত জমি জেগে উঠলে তা জমির মালিককে ফেরত দেয়ার আইন প্রণয়ন করা হয়।

 

 

বিদ্যুৎ

 

বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করে লোডশেডিং পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখা হয়। শিল্প-কারখানায় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়। ৩৩০টি থানায় পল্লী বিদ্যুতায়ন করা হয়। ৫৮১ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন মোট ৪টি বিদ্যুত কেন্দ্র যথা: বাঘাবাড়ি (৯৭১ মেগাওয়াট), চট্টগ্রাম রাউজান-১ (২১০ মেগাওয়াট) ঘোড়াশাল (২১০ মেগাওয়াট), এবং সিলেটে কম্বাডন্ড সাইকেল (৯০ মেগাওয়াট), চালু করা ঘয়। এছাড়া ৭৯৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ৫টি কেন্দ্রের কাজ শুরু করা হয় এবং আরও ১০২০ মেগাওয়াট উৎপাদনের জন্য ৪টি কেন্দ্রের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।

 

 

হাঁস-মুরগি, গবাদি পশু চৎস্য চাষ

 

সহজ শর্তে ঋণ ও ব্যাপক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে হাঁস-মুরগি, মৎস ও গবাগি পশুর খামার প্রতিষ্ঠার বিপুল সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়ে লাখ লাখ বেকার নারী-পুরুষের কর্ম সংস্থানের সৃষ্টি করা হয়। দেশে সরকারি সহায়তায় গবাদি পশু পালন উৎসাহিত হওয়ার বিদেশ থেকে গুড়াদুধ আমদানির পরিমাণ টাকার অঙ্কে ছয়শ’ কোটি টাকা থেকে প্রায় একশ’ কোটিতে নেমে আসে। উন্মুক্ত জলমহল ইজারা প্রথার বাতিল করে প্রকৃত জেলে ও দরিদ্র গ্রামবাসীদের মৎস্য আহরণের অবাধ সুবিধা প্রদান করা ঘয়। ‘জাল যার জলা’ তার নীতি অনুসরণ করে প্রকৃত মৎস্যজীবীদেরকে জলমহল ইজারা দেয়া ঘয়।

 

 

যোগাযোগ ব্যবস্থা

 

প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ যমুনা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু এবং প্রায় ৭০% কাজ সম্পন্ন করা হয়। মেঘনা, গোমতী,  মহানন্দা, আত্রাই, শেওলা, ধরেশ্বরী-১ এবং ধরেশ্বরী-২ প্রভৃতি সেতুসহ সারাদেশে তিন শতাধিক ছোট- বড় সেতু ও হাজার হাজার কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। কয়েক হাজার কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ ও পাকা করা হয়, যার মধ্যে ছিল জেলা সদরের সাথে আন্তর্জাতিক মানের কয়েক হাজার মাইল জনপথ এবং প্রত্যেকটি উপজেলা সদরের সাথে সংযোগ সাধনকারী রাস্তা। ২য় বুড়িগঙ্গা সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। রূপসা সেতু, শীতলক্ষ্যা সেতু ও ভৈরব বাজারে মেঘনা সেতু নির্মাণের যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ও অর্থ বরাদ্দ করা হয়। আধুনিক ইঞ্জিন ও বগি আমদানি এবং রেল লাইন সমূহের সংস্কার করে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করা হয়। চট্টগ্রামে দেশের আধুনিকতম ও বৃহদায়তনের রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ করা হয়।  

 

 

টেলিযোগযোগ

 

পাঁচ বছরে সারা দেশে তিন লাখ নতুন টেলিফোন সংযোগ প্রদান করা হয়। সেই সাথে ২০০০ সালের মধ্যে ৮ লাখ নুতন টেলিফোন সংযোগ স্থাপনের ব্যবস্থা নেয়া হয়। দেশে সর্বপ্রথম কার্ডফোন, সেলুলারফোন, গ্রামীণ আইএসডি ফোন চালু করা হয়।

 

 

শিক্ষা

 

আইন প্রণয়ন করে সারা দেশে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। মেয়েদের জন্য দশম শ্রেণী পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। মেয়েদের লেখাপাড়ায় উৎসাহিত করার লক্ষ্যে দেশে সর্বপ্রথম উপবৃত্তি কর্মসূচি চালু করা হয়। দরিদ্র শিশুদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে শিক্ষার জন্য খাদ্য কর্মসূচির প্রচলন করা হয়। হাজার হাজার স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসা নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ করা হয়। উচ্চ শিক্ষা প্রসারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদালয় চালু করা হয়। দেশে সর্বপ্রথম বেসরকারি পর্যায়ে বেশকিছু সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। আরও কিছু সংখ্যক প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেয়া হয়।  শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে সমাবর্তন উৎসব চালু করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজট কমে আসে। বিশেষ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট না থাকায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। গণশিক্ষা কার্যক্রম ব্যাপকভাব সম্প্রসারিত করা হয়। বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকদের বেতনের অনুদান ৮০ ভাগে বৃদ্ধি ও তাদেরকে  টাইম স্কেল দেয়া হয়। প্রতিবছর শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়।

 

 

স্বাস্থ্য

 

স্বাস্থ্য বৃহত্তর জেলা সদরে ১০০ শয্যার হাসপাতালকে ২৫০ শয্যায় এবং ৫০ শয্যার হাসপাতালকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর শয্যা সংখ্যা ৩১ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা ঘয়। বহুসংখ্যক হাসপাতাল ও থানা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সে এম্বুলেন্স প্রদান করা ঘয়। এক বছরের কম বয়সি শতকরা ৮৫ ভাগ শিশুকে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আনা হয়। শতকরা ৯০ ভাগ জনগণের জন্য বিশুদ্ধ খাবার পানি প্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি করা হয়।

 

 

দুস্থ মহিলা

 

দুস্থ মহিলাদের স্বাবলম্বী করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ তহবিল থেকে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে দুস্থ মহিলাদের ঋণদান কর্মসূচি চালু করা হয়।

 

 

খনিজ সম্পদ

 

বড়পুকুরিয়া কয়লা এবং মধ্যপাড়ার কঠিন শিলা উত্তোলন প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়। ভোলা ও বঙ্গোপসাগরে নতুন গ্যাস ক্ষেত্র ও দিনাজপুরে কয়লা ক্ষেত্র আবিস্কৃত হয় তেল ও গ্রাস অনুসন্ধানের লক্ষ্যে প্রতি বছর দুটি কর অনুসন্ধান কূপ খননের উদ্যোগ নেয়া হয়।

 

 

পরিবেশ সংরক্ষণ ও বনায়ন

 

পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে এ সংক্রান্ত আইনসমূহ দৃঢ়ভাবে বাস্তবায়ন করা হয়। দেশব্যাপী বৃক্ষরোপন ও বনায়ন কর্মসুচির মাধ্যমে উপকূলীয় বেস্টনী গড়ে তোলা হয়। সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করে বেকার নারী ও পুরুষদের জন্য বৃক্ষরোপনের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়।

 

 

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা

 

১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্কারী গুর্ণিঝড় এবং পরবর্তীতে বন্যা ও খরা সফলভাবে মোকাবিলা করে  মূলত বিদেশ থেকে সাহায্য না নিয়ে সঠিক পুনর্বাসন কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়। উপকূলীয় এলাকায় ১ হাজারে বেশি বহুমুখী সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণ করা হয়।

 

 

ব্যাংক ও বীমা

 

বেসরকারী খাতে বেশ কিছু সংখ্যক ব্যাংক ও বীমা কোম্পানী প্রতিষ্ঠার অনুমতি দিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে বেসরকারি খাতে অংশগ্রহণ করা হয়, যার ফলে বিদ্যমান বিশৃংখলা বহুলাংশে দুর হয়। আনসার ভিডিপি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে আনসার-ভিডিপি সদস্যদের জন্য এ ব্যাংক থেকে আত্মকর্মসংস্থান প্রকল্পে ঋনের ব্যবস্থা করা হয়। দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করে মুক্তবাজার অর্থনীতি বিকাশের সহায়ক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।

 

 

প্রশাসন

 

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য পে-কমিশন গঠন ও তার সুপারিশ বাস্তবায়ন করে প্রাপ্য আর্থিক সুবিধা এক সাথে দেয়া হয়। তদুপরি অতিরিক্ত ১০% বেতন বৃদ্ধি মঞ্জুর করা হয়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের পেনশন জটিলতা নিরসন ও সহজীকরণ করে অবসর গ্রহনের সাথে সাথে পেনশন পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি এবং প্রথমবারের মতো অবসর প্রাপ্ত সরকারী কর্মচারীদের মৃত্যুর পর তাদের স্ত্রী এবং প্রতিবন্ধী সন্তানদেরও আজীবন পেনশন পাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সরকারি কর্মচারীদের জন্য ৩ হাজার বাসগৃহ নির্মাণ করা হয়। সরকারি চাকুরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছরে উন্নীত করা হয়। ফলে বিলম্বে শিক্ষা জীবন সমাপ্তির কারণে লাখ লাখ হতাশাগ্রস্থ যুবক ও যুব মহিলার কর্মসংস্থানের দ্বার উন্মোচিত হয়। পুলিশ, বিডিআর ও আনসার বাহিনীর সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণ করা হয়।

 

 

সশস্ত্র বাহিনী


দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বর অতন্দ্র প্রহরী সশস্ত্র বহিনীকে সম্প্রসারিত ও সুসজ্জিত করে একটি যুগোপযোগী আধুনিক বাহিনী রূপে গড়ে তোলা হয়।

 

মজুরি কমিশন


মজুরি কমিশন গঠন করে শ্রমিকদের জন্য মজুরি ও সুযোগ - সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়। এতদ্ব্যতীত, অতিরিক্ত ১০% মজুরি বৃদ্ধি করা হয়। গার্মেন্টসহ ব্যক্তিখাতে ১৭টি সেক্টরের শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়।

 

ইসলাম ধর্মীয় বিষয়াদি


ঢাকায় স্থায়ী হাজী ক্যাম্প নির্মাণ করা হয়। টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার জন্য ৩০০ একরেরও বেশি জমি তবলিগ জামাতকে প্রদান করা হয়। মাদ্রাসা শিক্ষকদের প্রশিক্ষনের জন্য ঢাকায় মাদ্রাসা ট্রেনিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়। এবতেদায়ী মাদ্রাসাকে বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলের সমপর্যায়ের সুযোগ - সুবিধা প্রদান করা হয়। মসজিদ, ঈদগাহ ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সংস্কার কাজে ব্যাপকহারে আর্থিক অনুদান প্রদান করা হয়।

 

ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিষয়ক


হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্ট, বৌদ্ধ কল্যাণ ট্রাস্ট ও খ্রিস্টান কল্যাণ টাস্টে সরকারি অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হয়। তফসিলি সম্প্রদায়ের ছাত্র - ছাত্রীদের জন্য তফসিলি বৃত্তি পুন:প্রবর্তন করা হয়। দুর্গাপূজাসহ অন্যান্য পূজা, জন্মাষ্টমী, শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথি প্রভৃতি অনুষ্ঠান যথাযথ মর্যাদা ও গুরুত্ব সহকারে রেডিও - টিভিতে প্রচার করা হয়।

 

 

নারী ও শিশু নির্যাতন রোধের আইন

 

নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি ‌মৃত্যুদন্ডে ও যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিধান করে নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন প্রণয়ন করা হয়।

 

 

মুক্তিযোদ্ধা গ্যালান্ট্রি এওয়ার্ড ও বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ

 

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। রায়ের বাজার বদ্যভূমিতে শহীদ বুদ্ধজীবি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

 

 

কোস্টগার্ড প্রতিষ্ঠা

 

দেশের জলসীমা পাহার, নৌ ও সমুদ্রপথে জলদস্যুতা দমন ও চোরাচালান রোধের লক্ষ্যে কোস্টগার্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়।

 

 

তিন বিঘা করিডোর

 

ভারতে কাছে থকে তিন বিঘা করিডোর ব্যবহারের অধিকার অর্জন করা হয়।

 

 

ফারাক্কা সমস্যা

 

ফারাক্কা সমস্যা জাতিসংঘে উত্থাপন এবং গঙ্গার পানি ন্যায্য হিস্যা আদায়ে ভারতকে রাজি করানোর জন্য আন্তুর্জাতিক ফোরামের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করার উদ্যোগ নেয়া হয়।

 

 

পাহাড়ি জনগণ ও চাকমা শরণার্থী

 

পাহাড়ি জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য বিশেষ বাজেট বরাদ্দ ও উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ গ্রহণ করা হয়। সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা শরণার্থীদের দেশে ফেরার এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

 

 

উন্নয় ও অগ্রগতিতে আওয়ামী লীগের বাধা

 

১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন বিজয়ী হয়ে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া সরকার গঠন করেন তিনি যখন করকার গঠন করে বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত গণতন্ত্র সুসংহত করার দায়িত্ব লাভ করেন, রাষ্ট্রীয় তহবিল তখন ছিল প্রায় শূন্য। জাতীয় বাজেট ছিল প্রায় ১০০ ভাগ বিদেশী ঋণ ও সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাজ করছিল চরম বিশৃঙ্খলা। প্রশাসনের সর্বস্তরে ছিল সীমাহীন দুর্নীতি ও অব্যবস্থা। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ধৈর্যের সাথে বিরাজমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেন এবং এক এক করে তা সমাধানের পদক্ষেপ গ্রহন করেন। জনস্বার্থে এসব সমস্যা সমাধানে বিরোধী দল আওয়ামী লীগের কাছ থেকে যে সহযোগিতা পাওয়া স্বাভাবিক ছিল, দুর্ভাগ্যক্রমে কোন ক্ষেত্রেই তা পাওয়া যায়নি। অথচ এরশাদের স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনের ফসল হিসেবেই বিএনপি ক্ষমতায় এসেছিল। ওই আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও ছিল শরীক দল। বিএনপি সরকারে আসায় আওয়ামী লীগ সহাযোগিতা তো করেইনি, উপরন্তও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন- ‘বেগম খালেদা জিয়ার সরকারকে এক মুহূর্তের জন্যেও শান্তিতে থাকতে দেয়া হবে না’।

 

আওয়ামী লীগের আন্দোলনের হুমকি নিয়েই বেগম খালেদা জিয়া অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সরকার পরিচালনা করতে থাকেন। এক বছর দু’বছর তিন বছরে উন্নীত হয় বিএনপি সরকারের মেয়াদ। সর্বক্ষেত্রেই সরকার সফলতা লাভ করে। দেশবাসী উন্নতির সুফলগুলো ভোগে করতে থাকেন। ঠিক এ মুহূর্তেই সবকিছু ছারখার করে দেয়ার আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। জাতীয় সংসদের ভেতরে বসে সকরারি দলের সদস্যদের জুতা দেখানো, ফাইল ছুড়ে মারা, ডেপুটি স্পিকারকে আক্রমণ করার চেষ্টা ইত্যাদি কর্মকা- বিরোধী দল শুরু করে সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা সংসদ নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ঝাকুনি দিয়ে ধাক্কা মেরে গণতন্ত্র শেখানোর অসংসদীয় ভাষাও প্রয়োগ করেন। এ ব্যবস্থা চলার এক পর্যায়ে ১৯৯৪ সালের ১ মার্চ জাতীয় সংসদে সরকার দলের সদস্য ব্যরিস্টার নাজমুল হুদার একটি মন্তব্যকে প্রত্যাহার এবং বক্তব্যের জন দুঃখ প্রকাশ করা সত্ত্বেও বিরোধী দল আর সংসদে ফিরে আসেনি। এরপর মাগুরা উপ নির্বচানকে কেন্দ্র করে তারা শুরু করে সংসদ বর্জন। পরবর্তীতে তত্তাবধায়ক সরকারের দাবিতে রাজপথে বিরোধী দল শুরু করে ভয়াবহ আন্দোলন এবং পরিকল্পিত নাশকতামূলক কার্যকলাপ। হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও, পরিকল্পিত  হত্যাকান্ড, এমন ঘটনা নেই যা ঘটেনি। ফলে বিএনপি সরকার যে সাফল্য অর্জন করে তা ম্লান হতে থাকে। বিরোধী দলকে আলোচনা করে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের বার বার আহ্বান সত্ত্বেও তারা তাতে সাড়া দেয়নি। বরং ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর সংসদ থেকে পদত্যাগ করে আন্দোলনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়া হয়।

 

সমঝোতার স্বার্থে নির্বাচনের ৩০ দিন আগে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তার সরকার ক্ষমতায় থাকব না বলে ঘোষণা দেন এবং এ সময়ে সরকার কিভাবে চলবে তা নিয়ে সংসদে আলোচনা প্রস্তাব দেন। কিন্তু পদত্যাগ থেকে বিরোধী দল বিরত হয়নি। তারা তখন সংসদে ফিরে এলে নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য গঠিত সরকারে সাংবিধানিক কাঠামো ঠিক করা যেতো। সংবিধান সংশোধনের জন্য দুই-তৃতীয়ংশ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন। বিএনপির দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য ছিল না। এটা জান সত্ত্বেও বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ পত্র জমা দিলেন এবং সংসদে আর এলেন না। ফলে  তাদের আসন শূন্য ঘোষিত হয়। উপ-নির্বাচনের মাধ্যমে বিরোধী দলকে পুনরায় সংসদে আসার আহ্বান জানান বেগম জিয়া । তাতে সাড়া দেননি। প্রেসিডেন্ট নেতৃত্বে নির্দলীয় বক্তিদের সমন্বয়ে উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের প্রস্তাব বিরোধী দলে ছিল। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কয়েকবার চিঠি দিয়ে এ নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেন। কিন্তু আলোচনায় আসেনি বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। এক পর্যায়ে কমনওয়েলথ মাহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টিফেন রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে মধ্যস্থতা করতে আসেন। উভয় পক্ষে আলোচনা হলো তার মধ্যস্থতায়। স্যার নিনিয়ান আলোচনা শেষে একটি সমঝোতা ফর্মুলা উপস্থাপন করেন। ফর্মূলা অনুযায়ী সংবিধানের কানে সংশেধনী ছাড়াই নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সংখ্যাগরিষ্ট দলের ৫ জন এবং বিরোধী দলের ৫ জন সংসদ সদস্য নিয়ে এ সকরার গঠিত হবে।  জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা হবে এ সরকারের প্রধান কাজ। কিন্তু এ প্রস্তাবটিও বিরোধী দল নাকচ করে দেয়। দেশের পাঁচ বিশিষ্ট নাগরিকও একটি উদ্যোগ নেন। সেটিও ব্যর্থ হয়ে যায়। এ অবস্থায় সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ জাতীয় সংসদের ষষ্ঠ নির্বাচন ঘোষণা করেন বেগম খালেদা জিয়ার সরকার। কারণ সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্বাচন করা ছাড়া বিকল্প ছিল না। তিনি আরও ঘোষণা করেন, এই নির্বাচনের পর গঠিত সংসদের প্রথম অধিবেশনেই ভবিষ্যতে সকল জাতীয় নির্বাচনকালীন সময়ে নির্দলীয় সরকার গঠনের সুস্পষ্ট বিধান সম্বলিত সংবিধান সংশোধনী বিল পাস করা হবে। এবং নুন্যতম সময়ের মধ্যে ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে যাতে সব রাজনৈতিক দল অংশ নিতে পারে। ১৫ ফেব্রুয়ারি সেই নির্বাচন হয়। কিন্তু এরই মধ্যে হরতাল-অবরোধ একের পর এক চলতে থাকে। ঘোষিত হয় অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি। ১৭৩ দিনে হরতাল, অবরোধ, অসহযোগ আন্দোলন ও জ্বালাও-পোড়ায়ের ফলে দেশ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে যায়। এ অবস্থায় ২৫ মার্চ রাতব্যাপী সংসদ চলে এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংসদে পাস হয় এবং আইনে পরিণত হয়। প্রধানমন্ত্রী  বেগম খালেদা জিয়া ৩০ মার্চ ১৯৯৬ প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান বিশ্বাসকে ষষ্ঠ সংসদ ভেঙে দেয়ার পরামর্শ দেন। ওই দিনই সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে তিনি সংবিধান অনুযায়ী গঠিত বিচারপতি হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এর আগে নয়াপল্টনে লাখ লাখ মানুষের এ ঐতিহাসিক সমাবেশে তিনি আবেগময় ভাষণ দেন।

 

 

বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপি

 

১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে পরিকল্পিত নীল নকশায় বিএনিপকে পরাজিত করা হয়। গণতন্ত্রের স্বার্থে এবং সাংবিধানিক শাসন বজায় রাখার স্বার্থে বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনের ফল মেনে নেন এবং নতুন সরকারকে অভিনন্দনও জানান। ব্যাপক কারচুপি সত্বেও বেগম খালেদা জিয়া দল বিএনপি সপ্তম সংসদে ১১৬টি আসন পেয়ে বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাসে বৃহত্তম বিরোধী দল হিসাবে আবির্ভূত হয়। বৃহত্তম বিরোধী দলের নেত্রী হন বেগম খালেদা জিয়া। তার নেতৃত্বে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপিকে গঠনমূলক রাজনীতি করতে দেয়া হয়নি। বিরোধী দলকে কথা কলার সুযোগ না দেয়া, অসত্য বক্তব্য ও ভুল তথ্য প্রদান করা, শেখ হাসিনা ও তার দলীয় সংসদ সদস্যদের অশালীন ও আক্রমণাত্মক ভাষা প্রয়োগ এবং স্পিস্কার কর্তৃক আওয়ামী কর্মীসুলভ আচরন ও পক্ষপাতিত্ব চরম আকার ধারণ করে। বস্তুতপক্ষে জাতীয় সংসদকে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের মতো পরিণত করা হয়।

 

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে ধরাকে সরা জ্ঞান করতে থাকে। প্রতিদিন খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, রাহাজানি, চাঁদাবাজি দখলবাজির মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরম অবনতি ছিল গণমানুষের বড় প্রাপ্তি। নারী নির্যতন বিশেষ করে নারী ধর্ষণ একটি প্রত্যাহিক ঘটনায় পরিণত হয়। দুর্নীতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। বিদ্যুৎখাতে হিমালয়সম ব্যর্থতার নজির রাখে এ সরকার। আওয়ামী পন্থী অযোগ্য দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তদের রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে বসিয়ে প্রশাসনকে অচল করে দেয়া হয়। বিচারপতিদের বিরুদ্ধে রাজপথে লাঠি মিছিল হয়। সুপ্রীম কোর্টে শেখ হাসিনাকে বিচারকদের সম্পর্কে অশালীন মন্তব্যের জন্য দু’বার কঠোরভাবে সতর্ক করে দেন। আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধকেও দলীয়কর করে ফেলে। রেডিও-টিভিকে কুক্ষিগত করে ১০০ ভাগ দলীয় ও পারিবারিক প্রচার মাধ্যমে পরিণত করে। অর্থনীতিকে চরমভাবে বিপর্যস্ত করা হয়। সকল জাতীয় প্রতিষ্ঠান শেখ হাসিনার পারিবারিক সদস্যদের নামে নামকরণ করা হয়। দলীয়করণ করা হয় শিক্ষাঙ্গনে। পাঁচ বছরে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকার চালায় চরম দমন-পীড়ন। হাজার হাজার রাজনৈতিক মামলা করা হয়। বিএনপির নেত-কমীকেই গ্রেফতার করা হয় প্রায় ৬০ হাজার। প্রায় চারশ বিএনিপ নেতাকর্মী নির্মম হত্যার শিকার হয়। বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয় অবরোধ, বিএনপির জনসভা ও মিছিলে হামলা থেকে শুরু করে এমন কোন কাজ নেই যা সরকার করেনি। এমনকি বেগম খালেদা জিয়া বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আক্রোশমূলক দু’টি মিথ্যা মামলাও দেয়া হয়।

 

আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন বেগম খালেদা জিয়া। তবে এ আন্দোলন ছিল নিয়মতান্ত্রিক। এ আন্দোলন করতে গিয়ে জনগণের ক্ষতির বিষয়টি সবসময় তিনি লক্ষ্য রেখেছেন। কিন্তু এই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনও ন্যাক্কারজন উপায়ে বাধা প্রদান করে আওয়ামী লীগ সরকার।

 

 

আওয়ামী সরকার বিরোধী আন্দোলন

 

আওয়ামী লীগ সরকারের পাঁচ বছরে বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সারাদেশে শত শত সভা-সমাবেশ করে আওয়ামী লীগ সরকারের দু:শাসনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম অভিমুখে লংমার্চ, দেশব্যাপী রোডমার্চ, গণমিছিল, সংসদ সদস্যদের নিয়ে ঢাকার রাজপথে মিছিল, গণঅনশন, মহাসামাবেশ, অবস্থান ধর্মঘট, সচিবালয় অভিমুখে কর্মসূচি এবং হরতারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকাররের দুঃশাসনের প্রতিবাদ করেন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সাত দলের লংমার্চ ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ঢাকা থেকে দুদিনের এই লংমার্চে জাতীয় ঐক্যের এক অন্তন প্রবাহ সৃষ্টি করে। লং মার্চে প্রবল গণজোয়ার প্রমাণিত হয় যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সব সময় মানুষ রয়েছে।  পার্বত্য কলো চুক্তির বিরুদ্ধে এই লংমার্চ চলাকালে ২৭৫ কিলোমিটরি সড়কপথে যে মানববন্ধন সৃষ্টি হয়েছিল তা ছিল অভূতপূর্ব। একইভাবে প্রতিটি রোডমার্চ এবং গণমিছিলেও লাখ লাখ মানুষ অংশ নেয়, সরকারের দুঃশাসনের প্রতিবাদ জানায়।

 

১৯৭৭ সলে পার্বত্য শান্তি চুক্তির নামে দেশের একটি অংশকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিরোধী দল হিসেবে বড় ধরণের প্রতিবাদ করে বেগম খালেদা জিয়ার দল। ওই বছরের ২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সরকার চুক্তি সম্পন্ন করলে লাখো জনতাকে সাথে নিয়ে বিরাধী দলীয় নেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ঢাকা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অভিমুখে স্মরণকালের বৃহৎ লংমার্চ করেন।

 

১৯৯৯ সাল থেকে সরকারের নানামুখি দেশ বিরাধী অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে বিএনপি। ১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারি ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়রপারর্সন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘সরকারের দেশ বিরোধী ও জনবিমুখ কার্যক্রমে দেশবাসী অতিষ্ঠ। যেসব রাজনৈতিক দল এতোদিন নিশ্চুপ ছিল, তারাও বুঝতে পেরেছে-এ সরকারে কাছে দেশ নিরাপদ নয়। এ সরকারের সাথে ঘর করা যায় না।’ তাই ফেব্রুয়ারি থেকেই সরকার পতনের আন্দেলনের ঘোষণা দেন বেগম খালেদা জিয়া।

 

২৯ জনুয়ারি আঞ্চলিক ও বিশ্বব্যাপী যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিশ্ব সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে বেগম খালেদা জিয়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নারী নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সমাজের ইজ্জত রক্ষায় আওয়ামী সন্ত্রসীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা জন্য তিনি বিএনপি নেতা-কর্মী ও নারী সমাজের প্রতি আহ্বান জানান।  (দৈনিক প্রথম আলো, ৩০ জানুয়ারি ১৯৯৯)

 

৪ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে বিশাল এক সমাবেশে বেগম খালেদা জিয়া পৌর নির্বাচনের তফসিল বাতিল, প্রধান নির্বাচন কশিনারের পদত্যাগসহ চার দফা মেনে নেযার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। অন্যথায় সরকার পতনের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে ঘোষণ দেন। তিনি ৯ থেকে ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪৮ ঘন্টা লাগাতার হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ওই হরতালে সজল ও মামুন আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হন। ১৩ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে মহানগর বিএনপি আয়োজিত শোক মিছিল ও সামাবেশে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, শোককে শক্তিতে পরিণত করে যে কোন মুল্যে আধিপত্যবাদীদের ‘মুখ্যমন্ত্রী’র পদত্যাগ ঘটানো হবে।

 

পৌর নির্বাচন বাতিল ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগের দাবিতে ১৪ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী নগরীতে এক বিশাল সমাবেশে বেগম খালেদা জিয়া জনগণের ভোগান্তি সৃষ্টি না করে অবিলম্বে দাবি মানতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। (দৈনিক ইনকিলাব, ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯)

 

৩ মার্চ একই দাবিতে হবিগঞ্জে আয়োজিত বিশাল এক সমাবেশে বেগম খালেদা জিয়া বক্তৃতা করেন।

 

৮ মার্চ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের ৪৩তম সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি দেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও প্রতিবেশি দেশের সাথে চুক্তির ক্ষেত্রে সরকারের গোপন তৎপরতা বন্ধের দাবি জানান। বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো গোপনে নেয়া  হচ্ছে। এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা একেবারেই অনুপস্থিত। সরকার কর্তৃক স্বাক্ষরিত গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক চুক্তি এবং তেল ও গ্রাস ব্লক বরাদ্দ চুক্তির কথা উল্লেখ করেন। (দৈনিক দিনকাল, ৯ মার্চ ১৯৯৯)

 

১৯৯৯ সালের ৫ এপ্রিল ঢাকায় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের দু’দিন ব্যাপী বর্ধিত সভার উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথির ভাষনে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘আওয়ামী লীগের লোকদের শুধু খাই খাই খাই, অর্থনীতি খেয়ে তারা এখন মানচিত্র খেতে শুরু করেছে। চারদিকে তাকালে শুনি-নাই নাই নাই, আর হায় হায় হায়। সন্তানের নিরাপত্তা নেই, অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে, টাকা নেই, ব্যবসা নেই, বিদ্যুৎ পানি গ্যাস নেই, কলকারখানায় উৎপাদন নেই। মান সম্মান রক্ষা হবে কিনা সেই চিন্তায় মানুষ করছে হায় হায়। আর আওয়ামী লীগের লোকেরা বলছে, খাই খাই খাই, চাই চাই চাই। তারা কত খায়? বলেছে ২১ বছর খাইনি। এখন অর্থনীতি খেয়ে দেশের মানচিত্র খেতে শুরু করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পর এবার দক্ষিণাঞ্চলে তথাকথিত বঙ্গভূমির ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে।’ এসব ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে দেশবাসীকে সাথে নিয়ে ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য বেগম খালেদা জিয়া ছাত্রদল নেতা-কমীদের দির্দেশ দেন।  (দৈনিক ভোরের কাগজ, ৬ এপ্রিল ১৯৯৯)

 

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে ৮ এপ্রিল এক জনসভায় চাল-ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতি, আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি, গ্রাস বিদ্যুৎ পানি সংকটের প্রতিবাদ জানিয়ে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ আরও কয়েক মাস ক্ষমতায় থাকলে দেশ ৫০বছর পিছিয়ে যাবে। গত ৩৩ মাসে শেখ হাসিনার সরকার দেশকে ২১ বছর পিছিয়ে দিয়েছে। ওই সমাবেশ থেকে তিনি দেশব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ১৫ এপ্রিল সারাদেশে বিক্ষোভ, ১৭ এপ্রিল বিক্ষোভ ও মশাল মিছিল, ১৮ এপ্রিল বিএনপি দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতার পালন করে।

 

১৯৯৯ সালের ৯ এপ্রিল ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) আয়োজিত চিকিৎসক সমাবেশে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা কেবল সারাদেশে নয়, এখন সংসদের ফ্লোরেও আসে। তারপরও এ সরকার চুপ। দেশের জনগণের সয্যের সীমা ভেঙ্গে গেছে। এ সরকারের সময় শেষ। জনগণ অন্যায়ের সমুচিত জবাব দেবে’। (দৈনিক প্রথম আলো, ১০ এপ্রিল ১৯৯৯)

 

আওয়ামী সরকারের দালাল হিসেবে বিবেচিত প্রধান নির্বচন কমিশনারের অধিনে অনুষ্ঠিত মেহেরপুর-১ আসনের উপনির্বাচনে অংশ না নিয়ে পাঁচ দফা দাবিতে ৩ মে গণমিছিলের আয়োজন করে বিএনপি। মিছিল পূর্ব সামাবেশে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘এ সরকারের অবস্থা নড়বড়ে হয়ে গেছে, ধাক্কা দিলেই পড়ে যাবে’। (দৈনিক ভোরের কাগজ, ৪ মে ১৯৯৯)

 

৫ দফা দাবিতে ঢাকা থেকে পঞ্চগড়ে তিনি দিনব্যাপী রোড মার্চ পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসমাবেশের মাধ্যমে ১৬ মে বেগম খালেদা জিয়া উদ্বোধন করেন। সমাবেশে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর নাম নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। ইনশাআল্লাহ আমরা কামিয়াব হবো’।  (দৈনিক ইনকিলাব, ১৭ মে ১৯৯৯)

 

রোডমার্চ ১৭ মে বগুড়ায় পৌঁছলে বেগম খালেদা জিয়া সেখানে এক সমাবেশে বক্তৃতা করেন। তিনি বলেন, ‘বিক্ষুদ্ধ দেশবাসী রাজধানী ঘেরাও করলে দুঃশাসনের হোতারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হবে। ১৮ মে রোডমার্চের শেষ দিনে বেগম খালেদা জিয়া পঞ্চগড়ের চিনিকল মাঠ ও দিনাজপুরের গাড়া শহীদ ময়দানে জনসভায় খালেদা জিয়া বলেন, ‘ভোট চুরি করে আওয়ামী লীগ ২১ বছর ক্ষমতায় এসেছে। এখন ক্ষমতা স্থায়ী করতে বিরোধী দল নির্যাতনে নেমেছে। তিন দিনের রোডমার্চ এই নির্যাতন ও দুঃশাসন প্রতিরোধের একটি বড় পদক্ষেপ। এভাবে জনগণকে সম্পৃক্ত করে আরও কঠোর আন্দোলন দিলে শেখ হাসিনার সরকার পতনে বেশী সময় লাগবে না’।

 

১৯৯৯ সালের ২৫ জুলাই পাঁচ দফা দাবিতে দ্বিতীয় রোডমার্চ শুরু হয়। ঢাকা, গাজীপুর ও বৃহত্তর ময়মনসিংহে এই রোডমার্চে বিভিন্ন সমাবেশে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, এই রোডমার্চের পর বৃহত্তর সিলেট ও খুলনায় দু’টি রোডমার্চ করা হবে। এসব কর্মসূচিতে জনগণের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে তিনি বিএনপি নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আপনারা জনগণ, নিজেদের কখনও দূর্বল মনে করবেন না। আওয়ামী সরকার পতনের লক্ষে হরতাল ঘেরাও অবরোধসহ লাগাতার কর্মসূচিতে রাজপথে থাকুন’। (দৈনিক ভোরের কাগজ, ২৬ জুলাই ১৯৯৯)

 

১৯৯৯ সালের ৯ আগস্ট ঢাকার মিরপুরে এক জনসভায় বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘রক্ত দেব, জীবন দেব। তবু ভারতকে ট্রানজিট প্রদানের চুক্তি করতে দেয়া হবে না।’ (১০আগস্ট ১৯৯৯, দৈনিক ইত্তেফাক)

 

ঢাকায় বস্তি উচ্ছেদের বিরুদ্ধেও বিএনপি বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে। লালবাগ আজাদ মাঠে বিএনপি আয়োজিত এক সমাবেশে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘পুনর্বাসন ছাড়া বস্তি উচ্ছেদ প্রতিরোধ করা হবে। প্রয়োজনে পার্বত্য চট্টগ্রাম পুনর্বাসন করুন’।

 

১৯৯৯ সালের ২৬ আগস্ট বিএনপির উদ্যোগে ঢাকা-ভৈরব রোডমার্চ করা হয়। রোডমার্চের বিভিন্ন পথসভায় সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য বেগম খালেদা জিয়া জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।

 

১৯৯৯ সালের ৪ সেপ্টেম্বর কলাবাগান ক্রীড়া চক্র মাঠে এক বিশাল জনসভায় আওয়ামী লীগকে ‘রক্ত চোষা মশা’র সাথে তুলনা করে রক্ত চোষাদের হাত হতে দেশ রক্ষা করতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। (৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ দৈনিক প্রথম আলো)

 

ভারতকে ট্রানজিট দিতে সরকারের পদক্ষেপ প্রতিরোধ করতে বিএনপি সচিবালয় অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করে। ১২ সেপ্টেম্বর ওই কর্মসূচিতে লাখো জনতার জমায়েত দেখে সরকার  ট্রানজিটের সিদ্ধান্ত থেকে এক পর্যায়ে ফিরে আসে।

 

১৯৯৯ সালের ৩ অক্টোবর হরতালে শেরপুরে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা বিদ্যুৎ তালুকদারের স্মরণসভায়  সরকারের সাথে যে কোন ধরনের আলোচনা বৈঠক নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, ‘খুনি দুর্নীতিবাজ চোরদের সাথে কিসের আলোচনা? আওয়ামী লীগের সময় শেষ। এখন ‘হটাও আওয়ামী লীগ, বাঁচাও দেশ, জনগণের নির্দেশে এসেছে’। (১০ অক্টোবর ১৯৯৯ দৈনিক ভোরের কাগজ)

 

১৯৯৯ সালের ৩০ নভেম্বর আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী আন্দোলন এক নতুন রূপ লাভ করে চারদলের শীর্ষ নেতার এক ঐতিহাসিক বৈঠকের মধ্য দিয়ে। ২৯, মিন্টু রোডে বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে এই বৈঠক হয়। এই বৈঠকটিই বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক চারদলীয় জোট সেদিন শুধু আন্দোলনের জন্য গঠিত হয়নি। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন, ঐক্যবদ্ধ নির্বাচন এবং ঐক্যবদ্ধ সরকার গঠনের জোট হিসেবেই গঠিত হয়। এ জোট থেকে এইচ এম এরশাদ আওয়ামী লীগের ফাঁদে পা দিয়ে বেরিয়ে যান। তবে তাতে জোটের সামান্য ক্ষতিও হয়নি। ইস্পাত কঠিন ঐক্যবজায় থাকে চারদলীয় জোটে। অবশেষ ১৫ জুলাই অবসান ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন শেখ হাসিনা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১ অক্টোবর অষ্টম সাধারন নির্বাচন ঘোষণা করেন। চার দলীয় ঐক্যবদ্ধভাবে এ নির্বাচনে অংশ নেয় এবং জনগণের ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয় লাভ করে বিএনপি। বিরোধী দলীয় নেত্রী থেকে বেগম খালেদা জিয়া নেত্রীর আসনে সমাসীন হন। গঠিত হয় ঐক্যবদ্ধ চারদলীয় জোটের সরকার।

 

 

অক্টোবর ভোট বিপ্লব

 

১ অক্টোবর ২০০১ সোমবার বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। দেশের সংবিধান অনুযায়ি একটি নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এ দিনটিতে উৎসব মুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের অষ্টম সাধারণ নির্বাচন। এ নির্বাচন বাংলাদেশে একবিংশ শতাব্দির প্রথম নির্বাচন। দেশ ও বিদেশের প্রায় তিন লাখ পর্যবেক্ষকসহ দেশের সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষ এই নির্বাচনকে অবাধ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং শন্তিপূর্ণ বলে একবাক্যে রায় দেয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ভারতসহ বিশ্ব সম্প্রদায় অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করায় বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশংসা করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ভোটার ১ অক্টোবরের এই নির্বাচনে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়।

 

১ অক্টোবর সোমবার ছিল ভোটের দিন। আর তাই ভোট উৎসবে মেতেছিল সারাদেশ। সর্বত্র নেমেছিল ভোটারদের ঢল। কি নারী, কি পুরুষ কিংবা কি নবীন, কি প্রবীণ সব ভোটারদের ভিড় উপচে পড়া। ভোটকেন্দ্রে অনেক লম্বা লাইন পড়ে। অনেক কেন্দ্রে দুই থেকে তিন ঘন্টা পর্যন্ত ধৈর্যের সাথে দাঁড়িয়ে থেকে মানুষ ভোট দেয়।  সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ-বিডিআর-আনসার বাহিনী এবং দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকের উপস্থিতিতে দেশে ভোট কেন্দ্রগুলো ছিল অহিংস ও শান্তিপূর্ণ। ভোটকেন্দ্রে নারী ভোটারের বিপুল সংখ্যক উপস্থিতি সবাইকে অবাক করে দেয়। তরুণ ভোটারের উপস্থিতিও ছিল বিপুল । সন্ধ্যার কিছু আগে থেকে শুরু হয় ভোট গণনা। সারাদিনের ভোটের গণজোয়ার  দেখেই অনুমান করা গিয়েছিল কিছু একটা ঘটবে। নারী ও তরুণদের ব্যাপক উপস্থিতি থেকেই বোঝা যায়, বিএনপির প্রতীক ধানের শীষের পক্ষে সাফল্য এসে গেছে। কারণ খালেদা জিয়াকে নারী ভোটাররা বেশি পছন্দ করেন। কিন্তু এ বিজয় যে কত সুস্পষ্ট ও বিরাট হতে যাচ্ছে কেউ তা জানতেন না। ১ অক্টোবর রাত সাড়ে এগারোটা থেকে বোঝা শুরু হয় এই বিজয়ের বিশালত্বের সম্ভাবনা।

 

 

বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের শাসনকাল (২০০১-২০০৬)

 

২০০১ সালের ১ অক্টোবর নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনিপর নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট বিজয়ী হয়। সরকারি হিসেবে নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার আগেই ২ অক্টোবর সোনারগাঁও হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা স্থূল কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেন। ১০ অক্টোবর চারদলীয় জোট সরকার গঠন করে। তবে এর আগেই শেখ হাসিনা জোট সরকারের পতন আন্দোলনের উদ্বোধন করেন। প্রধান বিরোধী দল হিসেবে সংসদে যাওয়ার আগেই স্বভাবসুলভ নির্বাচনের পরদিন থেকেই সরকারের পতন চাওয়া শুরু করে আওয়ামী লীগ। সরকারের পতনের জন্য হেন চেষ্টা নেই যে, ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে তারা করেননি। ২০০৪ সালের ৩০ এপ্রিল সরকারের শেষ দিনের আগাম ঘোষাণাও দেয় তারা। প্রধান বিরোধী দল হিসেবে তাদের একমাত্র দায়িত্ব ও কাজই ছিল সকারের পতন ঘটানো। দেশ ও দেশের মানুষ গোল্লায় গেলেও তাদের কিছুই যায় আসেনি। তাদের দরকার ছিল আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতার চেয়ারে বসা।

 

২০০৪ সালের ১৮ নভেম্বর প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ কতিপয় বাম দল সরকার পতনের লক্ষে ৯ দফা ঘোষণা করে। ৯ দফাটা মূলত ছিল ৭ দফা, আগে যা ছিল ১৫ দফা। শরিক দলের মন খুশি করার জন্য ৭ দফার সাথে আারো দু’টি দফা সংযুক্ত করে তারা ৯ দফা ঘোষণা করে। দফা ৭ হোক ৯ বা ১৫ হোক-সেটা মূল কথা ছিল না। মূল কথা ছিল ১ দফা-‘জোট সরকারের পতন’। বিরোধী দলগুলো তাদের ৯ দফা জাতির সামনে উপস্থাপন করে এবং কর্মসূচি হিসেবে তারা ১১ ডিসেম্বর টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত গণঅনাস্থা প্রাচীরের কর্মসূচি ঘোষণা দেয়।

 

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনার পর আওয়ামী লীগ একটি বড় ধরণের আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিয়েছিল। অবশ্য সে আশা তাদের পূরণ হয়নি। রোজার মধ্যে আন্দোলন করতে না পেরে ঈদের পরই তারা মাঠে নামে।

 

স্বাধীনতার পর ওই বছর প্রথম তিনটি ধর্মীয় বড় অনুষ্ঠান প্রায় একই সঙ্গে পালিত হয়। দেশে ৬০টি জেলায় বন্যা ও ৫৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের কারণে দেশে কৃষক দু’দুবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে জিনিসপত্রের দামের ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগ ছিল সর্বোচ্চ। দেশের মানুষের এবং সরকারের প্রত্যাশা  প্রচেষ্টায় জিনিসপত্রের দামও একটি সহনীয় পর্যায়ে নেমে যায়। যে কারণে নাগরিক দুর্ভোগের কোন ইস্যু না পেয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ছোট ছোট বাম দলগুলো সরকার পতনের আন্দোলন জোরদার করার ঘোষণা দেন।

 

সরকারের কোন ভাল কাজই আন্দোলনকারীদের চোখে পড়েনি। আওয়ামী লীগের রেখে যাওয়া ১১০ কোটি ডলারের রিজার্ভ বেড়ে ৩২৭ কোটি ডলার হয় বিএনপির প্রথম তিন বছরে ৪০০০ কোটি টাকা তাৎক্ষণিক বন্যা পুনর্বাসন কার্যক্রম, ৪৯ লাখ কৃষককে বীজ, সার এবং কীটনাশক বিনামূল্যে দিয়ে পুনর্বাসন, ৬শ’ কোটি টাকার কৃষি ভুর্তুকি, ৫শ’ কোটি টাকার কৃষি ঋণের সুদ মওকুফ, খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা, পরীক্ষায় নকল বন্ধ, ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বৃদ্ধি, ৫০ হাজার কিলোমিটার নতুন বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণ, রফতানি বাণিজ্য বৃদ্ধি, পলিথিন বন্ধ, শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, বিদেশি সর্বোচ্চ বিনিয়োগ, মাথাপিছু আয় ৩২৭ ডলার থেকে ৪৪৪ ডলারে উন্নীত করা, সর্বোপরি সন্ত্রাস দমনে অভূতপূর্ব সাফল্য, দ্রুত বিচার আইনের সাফল্য-কোন কিছুই বিরোধী দল দেখতে পায়নি।

 

২০০৪ সালের শেষের দিকে তারা ৯ দফা ঘোষণা করে। ৯ দফার প্রথম দফাই হলো ‘দেশকে উগ্র সাম্প্রদায়িক সশস্ত্র অপশক্তির হাত থেকে রক্ষা করতে সরকার ও প্রশাসনের সর্বস্তর থেকে যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের বিতাড়ন করতে হবে’। জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরই আওয়ামী লীগ মৌলবাদের ঢোল নিয়ে মাঠে নামে। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা পৃথিবীর এমন কোন জায়গা নেই যেখানে তিনি এ সরকারের বিরুদ্ধে বলেননি এবং তার বলার ঢংটাই ছিল ‘বাংলাদেশে মৌলবাদ আর তালেবান ক্ষমতায় বসেছে’। কারণ ‘মৌলবাদ’ পশ্চিমা বিশ্বের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় বিষয়। আর ইসলামী মৌলবাদ হলে তো কথাই নেই। শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগের মূল টার্গেটেই সেদিকে। পশ্চিমা বিশ্ব ও বন্ধুপ্রতিম পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রটি যাতে জোট সরকারের ভিত নড়ে যায় তবেই তারা ক্ষমতায় বসতে পারে। ১ম দফার আর একটি অংশ হলো, ‘ধারবাহিক গ্রেণেড হামলার তদন্ত ও দায়ীদের বিচার’। এ বিষয়ে বলতে গেলে ধারাবাহিক বোমা হামলার বৃহত্তম ৯টি হামলাই হয় আওয়ামী লীগ সকেরারের আমলে। সবচেয়ে বড় হামলাটি হয় নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ অফিসে এবং সেখানে ২২ জন মানুষ মারা যায়। কেন তারা ওইসব তদন্ত ও তাদের ৫ বছরে হয়নি এবং দোষীদের শাস্তি দেয়া হয়নি? বিএনপির সময় প্রধান হামলা দু’টির একটি ছিল বৃটিশ হাইকমিশনারের ওপর বোমা হামলা, অপরটি ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় হামলা।

 

এ দু’টি হামলার তদন্তে সরকারের যে  চেষ্টার কোন অন্ত ছিল না তা সবারই জানা। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা, ইন্টারপোল এফবিআইসহ দেশি-বিদেশী সব সংস্থা তদন্ত করে। বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের মাধ্যমেও তদন্ত করা হয়।

 

দ্বিতীয় দফা ছিল, ‘সন্ত্রাস বন্ধ, সন্ত্রাসী ও গডফাদারদের চিহ্নিত করে তাদের গ্রেফতার ও বিচার করা, সন্ত্রসীদের রজনৈতিক দল থেকে বহিস্কার ও সুস্থ রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু সন্ত্রাস বন্ধের দাবী আওয়ামী লীগের মুখ থেকে শুনে দেশবাসী বিস্ময়ে হতবাক হন। জয়নাল হাজারী, শামীম ওসমান, আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ, হাজী সেলিম, বোমা মানিক, ডা. ইকবালসহ হাজার হাজার সন্ত্রাসীর কর্মকান্ড তখনো গ্রামবাংলার জনপদের মানুষের মুখে মুখে। বাংলাদেশেকে সন্ত্রসীদের একটি অভয়ারণ্যে পরিণত করেছিল আওয়ামী লীগ এবং সেই সন্ত্রসীরা তখনও বহাল তবিয়তে আওয়ামী লীগে ছিল। কিন্তু সন্ত্রাসীদের রাজনৈতিক দল থেকে বহিস্কার করতে আওয়ামী লীগের কোন পদক্ষেপ না দেখে দেশবাসী আরও হতবাক হয়। আওয়ামী দলীয় ওই সন্ত্রসীদের বহিস্কার বিএনপি সরকার করতে পারেনি। তবে নির্বাচীন ওয়াদা অনুযায়ী, বিএনপি সন্ত্রাস বন্ধে নানামুখি পদক্ষেপ নিয়েছিল, সাধারণ জনগণের কাছে ব্যাপক প্রশংসা পায়।

 

তবে আমেরিকাতে শেখ হাসিনা এক সভায় বলেছিলেন, ‘র‌্যাপিট এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন আওয়ামী লীগের সাম্ভব্য প্রার্থী, আর রাজনৈতিক নেতাদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করছে’ (জনকণ্ঠ ১৭ নভেম্বর, ২০০৪)। কালা জাহাঙ্গীরের সহযোগী লিয়াকত, পিচ্চি হান্নান, খুলনার মৃণাল, চট্টগ্রামের ইকবাল প্রমুখ ভয়ংকর সন্ত্রাসী যদি আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী হয় বা তাদের রাজনৈতিক কর্মী হয়ে থাকে, তাহলে তখন সরকারের বলার কি-ই-বা থাকে। ২০০৪ সালের ২৭ নভেম্বর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সিলেটে বলেন, ‘মানিক একজন ভালো মানুষ’ (আমার দেশ, ২৮ নভেম্বর ২০০৪)। যে মানিকের বাসায় বোমা বানানোর সময় ১৯৯৯ সালে ২ জন মানুষ মারা যায় এবং যিনি বোমা মানিক নামে খ্যাত, তিনি হলেন ভালো মানুষ! আওয়ামী লীগের একজন প্রেসিডিয়াম সমস্য এবং খোদ সভানেত্রী যদি এমন কথা বলেন, তবে দেশবাসীর বুঝতে বাকি থাকবেনা যে, আওয়ামী লীগ দেশ থেকে সন্ত্রাস নির্মূল চেয়েছে কতখানি।

 

আওয়ামী লীগের ৩য় দফায় উত্থাপিত ‘স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন’ বিএনপি তথা চারদলীয় জোটের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ি তা আগেই বাস্তবায়ন করা হয়। সেহেতু স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন বিএনপিরই চিন্তার ফসল।

 

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের’ ৪র্থ দাবিটির ব্যাপারে সরকারের কার্যক্রম এবং এর সুফল জনগণ পেয়েছে। বিএনপি সরকার পদক্ষেপ ও ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য নাগালের মধ্যে রেখেছিল। আর এর প্রমাণ পরবর্তী সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক ও বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলেই জনগণ ভালভাবে অনুধাবন করছেন।

 

এরপর আওয়ামী লীগের দাবি ছিল ‘কৃষি উপকরণের মূল্য হ্রাস, ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত ও কার্যকর কৃষি পুনর্বাসন করতে হবে। তবে দাবির আগেই বড় বড় বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে কৃষকদের প্রয়োজনীয় সহায়তা বেগম খালেদা জিয়ার সরকার দিতে সক্ষম হয়েছিল। কেননা জোট সরকারের প্রথম তিন বছরে সরকার ৫ হাজার টাকার কৃষি ঋণের সুদ মওকুফ করে। ৬শ’ কোটি টাকা কৃষি ভর্তুকি প্রদান করে। ৪৯ লাখ কৃষককে ১ বিঘা করে জমি চাষের বীজ, সার, কীটনাশক বিনা মূল্যে বিতরণ করে।

 

‘জাতীয় স্বার্থে তেল, গ্যাস, বন্দরসহ জাতীয় সম্পদের পরিকল্পিত সর্বোচ্চ ব্যবস্থা’-এর যে দাবিটি ছিল-‘পাবর্ত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ বাস্তবায়ন। বিএনপি তথা চারদলীয় জোট আগে থেকেই এ চুক্তির বিরোধিতা করে আসছিল। ফলে এ দাবি নিয়ে বিএনপি স্পষ্টভাবে ‘নেতিবাচক’ জবাব দিয়ে দেয়।

 

সর্বশেষ দাবি ছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের পতন। বেগম খালোদা জিয়া সরকারের পতন ছাড়া আওয়ামী লীগ আলোচনায় বসতে সম্মতি ছিল না। অবশ্য পরবর্তীতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের দুই মহাসচিব পর্যায়ে সংলাপ অনুষ্ঠিত হলেও সেখানেও সরকারের পতন ছাড়া আওয়ামী লীগের সুমতি আসেনি বলে জানালো হয়। এরপরও নানামুখি ষড়যন্ত্র, বিদেশে গিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা ও বিএনপির পাঁচ বছরে ১৭৩ দিনের হরতাল-অবরোধের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে ব্যাহত করা ও জনদূর্ভোগ সৃষ্টি করাই ছিল আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার মুল দায়িত্ব। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার এসব নেতিবাচক পরিস্থিতি পার করেই দেশকে ‘আমার্জিং টাইগার’ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। বেগম খালেদা জিয়ার নানা বিচক্ষণ পদক্ষেপে দেশ বিভিন্ন দিক থেকে এগিয়ে যায় অনেক দুর।

 

২০০১ সালে সরকার গঠনের পর বেগম খালেদা জিয়া ১০০ দিনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এরপর প্রতি বছর বার্ষিক পরিকল্পনা নিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে নানামুখী পদক্ষেপ নেন তিনি। যার কিছু বর্ণানা উল্লেখ করা হলো:

 

 

শিক্ষা ক্ষেত্রে অতুলনীয় সফলতা

 

বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রশংসা পায় এ সরকার। অবাধ নকল বন্ধ করতে ২০০২ সাল থেকে সারা দেশে জিহাদ ঘোষণা করা হয়। ২০০৫ সালের মধ্যে সকল পাবলিক পরীক্ষা নকল মুক্ত করা হয়। দেশের ৪টি বিআইটিকে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৪ তে উন্নীত করা এবং ২৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে উচ্ছ শিক্ষার ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। এতে উচ্চ শিক্ষার্থে মেধাবীদের বিদেশে গমণের হার কমে আসে। সরকারের প্রথম বছরই স্কুল-কলেজে কম্পিউটার প্রদান করে শিক্ষাকে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগানো হয়। ১৯ জানুয়ারি সরকারিভাবে ‘শিক্ষক দিবস’ পালন এবং শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের পুরস্কার দেয়ার প্রচলন শুরু করে। সব শিক্ষককে অবসর ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করে বিএনপি সরকার। স্কুল বয়সী শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমন নিশ্চিত করতে এক সন্তানের গরীব পরিবারকে মাসে ১০০ টাকা এবং একাধিক সন্তানের পরিবার মাসে ১২৫ টাকা করে দেয়া শুরু করা হয়।

 

 

স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা

 

প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে বেড বাড়ানো হয়। বগুড়ায় একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপন করা হয়। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসাপাতাল এবং জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানের আর্সেনিক ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশের টিউবওয়েলের পানি পরীক্ষা করে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হয়। বিকল্প পানি ব্যবহারের সুযোগও সৃষ্টি করা হয়েছিল।

 

 

যোগাযোগ ব্যবস্থা

 

জোট সরকারের পাঁচ বছরে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের বিপ্লব সাধিত হয়। অসংখ্য সড়ক-মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মিত হয়েছে। সড়ক যোগাযাগ ব্যবস্থায় আসে নতুন যুগ। এ সময়ে সারাদেশে ৫৫ হাজার কিলোমিটার নতুন সড়ক, ২৪টি বড় সেতুসহ ১৪ হাজার ২০৯ মিটার দীর্ঘসেতু এবং ৩ হাজার ৪০৯ মিটার দীর্ঘ কালভার্ট নির্মিত হয়।

সড়ক যোগাযোগের পাশাপাশি রেলওয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের ও নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়। রাজশাহী, খুলনা ও লালমনিরহাট থেকে যমুনা সেতুর ওপর দিয়ে জয়দেবেপুর হয়ে সরাসরি ঢাকা পর্যন্ত ট্রেন সার্ভিস চালু করা হয়।

দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ৯০ শতাংশ নৌপথে পবিহন করা হয়। এছাড়া ৫ লাখ হ্যান্ডলিং ক্ষমতা ও ১ হাজার মিটার বার্থ সম্পন্ন নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করা হয় মহাখালি ও খিলগাঁওয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণ করে রাজধানীর যানজট কমিয়ে আনা হয়।

 

 

দারিদ্র্য বিমোচন

 

জাতিসংঘ ঘোষিত উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল, সংক্ষেপে এমডিজির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকার দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র প্রণয়ন করে। দারিদ্র্য নিরসন কর্মসূচিতে ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরের বাজেটে মোট সম্পদের ৫৪ শতাংশ এবং ২০০৬-২০০৭ অর্থবছেরে ৫৬ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়।

 

পল্লী অঞ্চলে অতি দরিদ্র ও সুবিধা বঞ্চিত মানুষের কর্ম সংস্থানসহ প্রত্যক্ষভাবে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে অর্ধশত কোটি টাকারও বেশি একটি তহবিল গঠন করা হয়। চরাঞ্চলের দরিদ্র্য জনগণের জীবিকায়নের লক্ষ্যে প্রায় পাঁচ শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে চর জীবিকায়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। গৃহিত এসব পদক্ষেপের ফলে ৫ বছরে ৯ শতাংশ দারিদ্র্য কমে। অতি দারিদ্রের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে আসে।

 

 

অর্থনৈতিক অগ্রগতি

 

দায়িত্ব নেয়ার সময় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থাকলেও বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকার পাঁচ বছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ বিলিয়ন ডলারের ওপরে নিয়ে আসে। অনেক বেশি দামে তেল কেনা সত্ত্বেও দেশের এই অথনৈতিক মজবুত অবস্থায় রাখতে সক্ষম হয়। যেখানে ২০০২ সালে রেমিটেন্স ছিল ১ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেখানে ২০০৫ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ দশকি ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

 

২০০৫ সালে কোটা প্রথা উঠে যাওয়ার পরও জোট সরকারের নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশে রফতানিমুখি গার্মেন্টস শিল্পের কোন ক্ষতি হয়নি। বরং কোটামুক্ত বিশ্ববাজারে বাংলাদেশে গার্মেন্টস রফতানির পরিমাণ বেড়েছে।

 

২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হার ছিল প্রায় ৭ শতাংশ। এটা বাংলাদেশে ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেকর্ড। পাঁচ বছরে মাথাপিছু জাতীয় আয় বেড়েছে। ২০০৫-২০০৬ অর্থবছেরে মাথাপিছু জাতীয় আয় দাঁড়িয়েছে ৪৮২ মার্কিন ডলার । আর মাথাপিছু জিডিপি দাঁড়িয়েছে ৪৫৬ মার্কিন ডলার।

 

 

দূষণমুক্ত ঢাকা

 

ঢাকাকে দূষণমুক্ত করতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া হয়। ক্ষতিকারক পলিথিন নিষিদ্ধ করে তা বাস্তবায়ন ছিল এই সরকারের জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। টু স্ট্রোক ইঞ্জিন চালিত যানবাহন ঢাকা শহর থেকে উঠিয়ে দিয়ে বায়ু ও শব্দ দূষণ রোধে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নেয়া হয়। জনসাধারণের যানবাহানের জন্য বাড়ানো হয় দোতলা বাসের সংখ্যা।

 

 

ফোন ও ইন্টারনেট সুবিধা

 

২০০২ সালের পর বাংলাদেশে আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট সুবিধার বিপ্লব সাধিত হয়। সরকারের প্রথম বছরেই বিটিটিবির ইন্টারনেট সুবিধা নতুন ৩৬টি জেলায় সম্প্রসাতির করা হয়। বিটিটিবির উদ্যোগে ‘টেলিটক’ মোবাইল কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করে বিদেশী মোবাইল কোম্পনীগুলোর একক আধিপত্যের নাগাল টেনে ধরা হয়। এত ফোন কলচার্জ ও ইন্টারনেট সংযোগ ফি কমে আসে।

 

বিদ্যুৎ ও গ্যাস

 

সরকারের প্রথম বছরেই ১৩৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো হয়। বেসরকারী খাতে স্থাপিত মেঘনা ঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্র এ সরকারের সময়ে উৎপাদন শুরু করে। দেশের উত্তরাঞ্চলে গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়।

 

 

কর্মসংস্থান

 

সরকারি অন্যান্য চাকুরির পাশাপাশি পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে গতিশীল করে শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের কাঙ্খিত বিসিএস প্রতিবছর চালু করা হয়। সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২১তম বিসিএস ও ২২তম বিসিএস-এর নিয়োগ প্রক্রিয়া খুব কম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করে। ২৩তম বিসিএস-এর নিয়োগের বিষয়টিও ইতিবাচকভাবে দেখা হয়। ২৫, ২৫ ও ২৬তম বিসিএস-এর নিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি শিক্ষার্থিদের মধ্যে পড়ালেখার প্রতি আকর্ষনে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে। পাঁচ বছরে দেশে কর্মসংস্থান হয় প্রায় ৫০ লাখ মানুষের। একই সময়ে বিদেশে ১২ লক্ষাধিক বাংলদেশেীর কর্মসংস্থান হয়। দেশে-বিদেশ আরো সাড়ে ৭ লাখ লোকের নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন ছিল। এছাড়াও ঋণ ও প্রশিক্ষণ নিয়ে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে আরো ৫০ লাখ লোকের।

 

 

শ্রমবাজার

 

দেশে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার পাশাপাশি তরুণদের দক্ষ ও যোগ্য করে তুলতে অগণিত ট্রেনিং সেন্টার গড়ে তোলা হয়। আর প্রশিক্ষিত তরুণ-যুবকদের বিদেশের বিভিন্ন দেশে চাকুরির সুযোগ সৃষ্টি করতে সরকারের পদক্ষেপ ছিল অত্যন্ত কার্যকর। বিশেষ করে সৗদি আরব, মালয়েশিয়া, কাতার, ইটালি, দক্ষিণ কোরিয়া, গ্রিস, অস্ট্রেলিয়া ও জর্ডানে লাখ লাখ বাংলাদেশী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, নার্স, নাবিক ও শ্রমিক নিয়োগ করা হয়। ইটালি ও দক্ষিণ কোরিয়ায় বাংলাদেশী অবৈধ অভিবাসীদের বৈধ করার প্রক্রিয়া করা হয়।

 

 

বিদেশী বিনিয়োগ

 

পাঁচ বছরে জোট সরকারের বিনিয়োগমুখী অর্থনৈতিক নীতি, কৌশল ও স্টেটেজির ফলে শিল্প উন্নয়নের ক্ষেত্রে  বাংলাদেশ যে বিশালভাবে এগিয়ে গেছে, সেটা গোটা বিশ্বের নজর কাড়ে। নেতৃত্ব স্থানীয় আন্তর্জাতিক মার্চেন্ট ব্যাংকার গোল্ডম্যান স্যাক্স তাদের একটি সাড়া জাগানো রিপোর্টে বিশ্বে দ্রুত অগ্রগামী মাত্র ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও যে আছে, সেই তথ্যটি তুলে ধরেন।

 

বাংলাদেশে শিপ-বেকিং থেকে শিপ-বিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রিতে এগিয়ে আসে। মার্চ ২০০৬ সাল পর্যন্ত পৌনে পাঁচ বছরে প্রায় ৬২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার শিল্প প্রকল্প বিনিয়োগ বোর্ডে রেজিষ্ট্রেশন হয়েছে, যা পরবর্তী পাঁচ বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। এ সময়ে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুবিখ্যাত কিছু শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে শ’ শ’ কোটি ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে আসে।

 

 

নারী অধিকার

 

নারীদের অধিকার ও মর্যাদা বৃদ্ধিতে সরকারের পদক্ষেপ ছিল অত্যন্ত কার্যকর। নারী নির্যাতন ও এসিড নিক্ষেপ রোধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও এর বাস্তব প্রয়োগ করা হয়। দুঃস্থ মহিলাদের ভাতা বাড়ানো হয়। দারিদ্র্য মোচন কর্মসূচির মধ্যে ‘ব্লাক বেঙ্গল ছাগল’ পালনের জন্য সহজ শর্তে ঋণ দেয়া হয়। দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মেয়েদের ফ্রি লেখাপাড়া ও উপবৃত্তি চালু করা হয়।

 

মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা বৃদ্ধি

 

যথার্থভাবেই মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা বাড়াতে নানামুখি পদক্ষেপ নেয় বেগম খালেদা জিয়ার সরকার। মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকার নিশ্চিত করতে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় স্থাপন করা হয় অসচ্ছল ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়ানো হয়। যেসব মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছেন তাদের পরিবারকে এককালীন ২৫ হাজার টাকা অনুদান দেয়া হয়।

 

 

স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালীকরণ

 

স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করে সমাজের অপরাধ প্রবণতা ও বিশৃঙ্খলা কমাতে গঠন করা হয় গ্রাম সরকার। স্থানীয় পর্যায়ে প্রশাসনিক ও উন্নয়ন কর্মকান্ডের সুবিধার্থে নতুন ৪টি উপজেলা, ১২টি পৌরসভা ও ৭টি ইউনিয়ন পরিষদ গঠন করা হয়।

 

 

কৃষিতে বিপ্লব

জোট সরকারের পাঁচ বছরে কৃষি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা হয়। ২০০৪ সালে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ৫০ লাখ প্রান্তিক কৃষককে বিনামূল্যে বীজ ও সার সরবরাহ করা হয়। ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত কৃষি ঋণের সুদ ও দন্ডসুদ মওকুফ করা হয়। এতে প্রায় ১৫ লাখ কৃষক সরাসরি উপকৃত হন।

 

কৃষকের কাছে কৃষি উপকরণ সুলভে ও ঠিক সময়ে পৌঁছে দেয়া, কৃষি ঋণ বিতরণ পদ্ধতি সহজকরণ, কৃষি খাতে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিলে ২৫ শতাংশ ভর্তুকি দেয়া এবং কৃষিখাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করা হয়।

 

বিগত আওয়ামী লীগ সরকার যেখানে কৃষিখাতে মাত্র ১০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছিল, জোট সরকার সেটা বাড়িয়ে ১২০০ কেটি টাকা ভর্তুকি দেয়।

 

একই সময়ে কৃষিঋণ বিতরণের পরিমাণ বাড়ানো হয়। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৫০০০ কোটি টাকা। কৃষিভিত্তিক শিল্প বিকাশের লক্ষ্যে বিভিন্নমুখি ইনসেনটিভ দেয়া হয়। কৃষিঋণে সুদের হার কমানো হয়। কৃষকদের মধ্যে উন্নত বীজ সরবরাহ করা হয়। আবাদ মৌসুমে পর্যাপ্ত পরিমাণ সার সরবরাহ করা হয়। সেচ সুবিধার সম্প্রসারণ এবং আধুনিকায়ন হয়। আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়। ফলে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে খাদ্য উৎপাদান হয় ৩০ দশমিক ৫ মিলিয়ন মেট্টিক টন। কৃষি উন্নয়নে গৃহীত এসব পদক্ষেপের ফলে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে কৃষিখাতে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশে উন্নীত হয়।

 

 

শিল্প কারখানা

 

বিএনপি সরকারের সময়ে দেশের জিডিপিতে শিল্পখাতের অবদান ১৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। শিল্পখাতে প্রবৃদ্ধির হার গত ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ১০ শতাংশ অতিক্রম করে। বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিল্প  নীতি ২০০৫-০৬ এর আলোকে বেসরকারি খাতে শিল্প প্রতিষ্ঠা এবং সরকারি মালিকানাধীন শিল্প-কারখানা বেসরকারিকরণ করে আসছে। ৩১টি শিল্প-কারখানা বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করা হয়। এরই মধ্যে কর্মকর্তা, শ্রমিক-কর্মচারীদের সকল পাওনা মিটিয়ে দিয়ে লোকসানমুখি আদমজী জুটমিলের জায়গায় একটি ইপিজেড স্থাপন করা হয়। সেখানে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা হয়। কর্মসংস্থান হয় প্রায় ১ লাখ লোকের।

 

 

সন্ত্রাস দমন

 

সন্ত্রাস দমনে ২০০২ সাল থেকে একাধিক পদক্ষেপ নেয়া হয়। বিশেষ করে অপারেশন ক্লিন হার্ট অভিযানে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সন্ত্রাসীদের দমনে প্রথম এই সরকার সফলতা পায়। দেশের কোথাও কোন গডফাদার সৃষ্টি হয়নি। দলীয় সন্ত্রসীদেরও রেহাই না দিয়ে আইন-শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে আপোসহীন ছিল এ সরকার। ক্লিন হার্ট অপারেশনের পর র‌্যাপিট অ্যাকশন ব্যাটলিয়ন গঠন করে দ্বিতীয়বারের মতো পদক্ষেপ নেয়া হয়। এরপর র‌্যাপিট অ্যাকশন ব্যাটলিয়নকে একটি স্থায়ী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতে রূপ দেয়া হয়। এসব বাহিনীকে দলীয় স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে ব্যবহার করায় জনগণের মাঝে ওই সরকারের পদক্ষেপ ব্যাপক প্রশংসিত হয়।

 

 

স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন

 

২০০১ সালে ক্ষমতা ছাড়ার আগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতিতে বিশ্বের চ্যাম্পিয়ন দেশের মর্যাদা পায় দুর্ভাগা বাংলাদেশ। এ অবস্থা থেকে দেশকে রক্ষা করার লক্ষ্যে বেগম খালেদা জিয়ার সরকার দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করে।

 

 

উপকূলীয় অঞ্চল রক্ষায় পদক্ষেপ

 

বৈশ্বিক উষ্ণতায় বাংলাদেশের উপকুল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এ বিষয়ে পরিবেশবিদদের তোড়জোড়ের আগেই বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সচেতন হয়ে উঠেন। ২০০২ সালে তাঁর সরকার উপকুল রক্ষায় ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেয়। অধিক মাত্রায় পরিকল্পিত উপায়ে নারিকেল ও তাল গাছ লাগোনোর কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। বেরি বাঁধ নির্মাণের জন্য বিশেষ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়।

 

 

গণমাধমের স্বাধীনতা ও বিপ্লব

 

২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর গণমাধ্যমকে আবার স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়া হয়। তথ্য প্রবাহের অবাধ স্বাধীনতার ফলে বিভিন্ন মতাদর্শের ডজনখানেক টেলিভিশন ও জাতীয় দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। গণমাধ্যমে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়।

 

 

ওয়ান ইলেভেনের পর নানা ষড়যন্ত্রের মুখেও আপোসহীন বেগম খালেদা জিয়া

 

২০০১ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন শেষে বেগম খালেদা জিয়ার সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে।

 

এদিকে বিদেশী প্রভূদের কাছ থেকে নানামুখি প্রেসক্রিপশন পেয়েও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনে জয়ের নিশানা না পেয়ে শুরু করেন নতুন ষড়যন্ত্র। লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ হত্যার মাধ্যমে তাদের ষড়যন্ত্রের সূচনা হয়। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তরের দিনে জাতীয় ইতিহাসে পৈশাচিক এক অধ্যায় সংযোজন করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের ক্যাডাররা। ওইদিন পল্টনে নৃশংসভাবে লগি-বৈঠা দিয়ে প্রকাশ্যে পিটিয়ে ৭ জনকে হত্যা করে তারা। এর মাধ্যমে তারা অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ভীত সন্ত্রস্ত্র প্রেক্ষাপটে বিচারপতি এম এ আজিজের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে দেশব্যাপী এক অনিশ্চিত অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি করা হয়। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচন বানচালের জন্য এক কঠিন ষড়যন্ত্র চলে। এরই ধারাবাহিকতায় নির্ধারিত তারিখের সংসদ নির্বাচন বানচাল ও ওয়ান  ইলেভেনের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

 

ওয়ান ইলেভেনে সরকার প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই প্রতিবেশি একটি দেশ ও আন্তর্জাতিক মহল ষড়যন্ত্রে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। ২২ জানুয়ারির নির্বাচন বানচালের জন্য তখন জাতিসংঘের নামে একটি ষড়যন্ত্রমূলক বিবৃতি প্রচার করা হয়। জরুরি অবস্থা জারির দিনে বিকেলে কানাডীয় হাইকমিশনারের বাসায় প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতাদের ডেকে নিয়ে জরুরি অবস্থা জারি এবং এতে তাদের সমর্থনের কথা জানিয়ে দেয়া হয়। এছাড়া জরুরি অবস্থা জারির আগে তৎকালীন সেনাপ্রধানের সাথে একজন প্রভাবশালী পশ্চিমা কুটনীতিকের সাক্ষাত-এ সব কিছুই ওয়ান ইলেভেনের সরকারের সাথে বিদেশী ষড়যন্ত্রের প্রমাণ বহন করে।

 

দেশী-বিদেশী নিখুত ষড়যন্ত্রের ফসল ছিল এই ওয়ান ইলেভেনের সরকার। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ অপর দুই বাহিনী প্রধান এবং নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি লে. জেনালের মাসুদ উদ্দীন চৌধুরীসহ আরও কিছু সেনা কর্মকর্তা বঙ্গভবনে গিয়ে অস্ত্রের মুখে রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহমদকে দিয়ে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করান এবং তত্তাবধায়ক সরকার প্রধানের পদ থেকে তাকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করেন। তারা প্রতিষ্ঠা করেন ড. ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন ওয়ান ইলেভেনে পুতুল সরকার। পরবর্তীকালে ডিজিএফআই’র তৎকালীন দুই পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বর্তমানে পলাতক) বারী ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিনকে সাথে নিয়ে এবং সাথে আরেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল (অব.) হাসান মশহুদ চৌধুরীকে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়াম্যান পদে বসিয়ে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতি দমনের নামে রাজনীতি দমন কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকেন। তাদের সাথে যোগ দেন আরেক সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তাকে গুরুতর অপরাধ দমন সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।

 

দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য মাইনাস টু ফর্মূলা বাস্তবায়নের জন্য নানা স্বৈরাচারী পদেক্ষেপ গ্রহণ করে এই সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যদিও পরবর্তী ঘটনসমূহের বাস্তবতায় দেখা গেছে, আসলে তাদের মূল টার্গেট ছিলেন বিএনিপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং বিএনপির ভবিষ্যত নেতা তারেক রহমান। সেনাপ্রধান জেনারেল মইনের মূল টার্গেট ছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল। কিন্তু সেনাবাহিনীর সর্বস্তরের কর্মকর্তাদের সমর্থন লাভে ব্যর্থতা, বিদেশী রাষ্ট্র্রগুলোর পুরো মদদ না পাওয়া এবং সর্বোপরি দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্দ্ধগতিসহ নানা কারণে দেশে মানুষের মনে এক পর্যায়ে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি নেতিবাচক মনোভাবের  কারণে জেনারেল মইনের সে চেষ্টা সফল হয়নি। তবে জেনারেল মইন বিএনপিকে তছনছ করে দেয়ার অপপ্রয়াস চালিয়ে অনেকটা সফল হয়।

 

ওয়ান ইলেভেনে মাস খানেকের মাথায় দুর্নীতি দমনের নামে ঢালাওভাবে রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার অভিযান চালানো হয়। এই অভিযানে বিএনপি নেতাদের বেধড়ক গ্রেফতার করা হয়। অনেকে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন। কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই ২০০৭ সালের মার্চ বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয় তার বিরুদ্ধে। রিমান্ডে নিয়ে তার ওপর সেনা গোয়েন্দারা অমানুষিক শারীরিক ও মানুষিক নির্যাতন চালিয়ে তাকে প্রায় পঙ্গু করে দেয়। এমনকি এক পর্যায়ে আদালতে দাঁড়িয়ে তারেক রহমান আশঙ্কা প্রকাশ করেন ‘আর রিমান্ডে নেয়া হলে তাকে মেরে ফেলা হতে পারে’। জনরোষের ভয়ে তারেক রহমানকে প্রাণে মেরে ফেলতে পারেনি দুর্বৃত্ত শাসকরা। তবে তার ওপর এমনভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে যে তাকে গত প্রায় আড়াই বছর দেশে-বিদেশে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।

 

এর পাশাপাশি দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এপ্রিল মাসে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে জোর করে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার অপকৌশল গ্রহণ করা হয়। তাঁর ওপর চাপ প্রয়োগের অংশ হিসেবে তারেক রহমানকে গ্রেফতারের পাশাপাশি ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে ২৪ ঘন্টা অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে আটকে রাখা হয়। বেগম খালেদা জিয়ার পাসপোর্ট পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। অন্যদিকে তখন বিদেশে অবস্থানরত শেখ হাসিনাকে দেশে আসতে দেয়া হবে না বলে ঘোষণা দিয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে চলে যাওয়ার জন্য চূড়ান্তভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয়। তবে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া কোন অবস্থাতেই বাংলাদেশ ত্যাগ করতে রাজি হননি। এর আগেই কার্যত: তাকে গৃহবন্দি করে ফলে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তার সাথে সবার যোগযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়। তাকে ২৬ মার্চে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পর্যন্ত যেতে দেয়া হয়নি। আত্মীয় স্বজনের সাথে পর্যন্ত সাক্ষাত করতে দেয়া হয়নি, দিনের পর দিন। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর নতুন করে বেগম খালেদা জিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ ও দল ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র আঁটে তৎকালীন সেনা সমর্থিত সরকার।

 

বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়াকে দিয়ে সেনা বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা বিএনপি ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র শুরু করে। মান্নান ভূঁইয়া এ বিষয়ে নিয়মিত মিডিয়ায় নানা ধরনের বক্তব্য প্রদান করতে থাকেন। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া অন্তরীণ থাকায় এ বিষয়ে কোন কথা বলোর সুযোগ পাচ্ছিলেন না। ১৯ জুন তিনি শাহবাগের বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দলের যুগ্ম মহাসচিব নজরুল ইসলাম খানকে দেখতে এসে সাংবাদিকদের বলেন, ‘দলের গুটি কয়েক নেতার মতামতের ভিত্তিতে নয়, সকলের মতামত নিয়েই দেশে সংস্কার হবে। তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত নেতাদের মতামত নেয়া হবে। জনগণের আশা-আকাঙ্খা অনুযায়ী সকলকে নিয়ে সংস্কার করব। বিএনপি একটি বিশাল দল। এ দলের নেতা-কর্মীরা যে ধরনের সংস্কার চাইবেন-সেই সংস্কারই হবে। দেশ ও দলের জন্য যেগুলো প্রয়োজন সে ধরনের সংস্কার করা হবে। আমারা চাই- আমরা যে সংস্কার করবো তাতে জনগণের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটুক। যখনই ঘরোয়া রাজনীতি শুরু হবে, তখনই এগুলি নিয়ে বসবো এবং আলোচনা করব।

 

বিএনপি ভাঙ্গার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে ২৫ জুন তৎকালীন বিএনপি মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে ডিজিএফআই তথাকথিত একটি ‘সংস্কার প্রস্তাব’ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে উত্থাপন করে। যেখানে ৬ বছেরের বেশি দলের চেয়ারপার্সন থাকা যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে সংস্কারের মূল লক্ষ্য ছিল বেগম খালেদা জিয়াকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া। বেশ কিছু নেতা মান্নান ভূঁইয়ার সংবাদ সম্মেলনে হাজির হলেও সমস্ত চাপ উপেক্ষা করে নেত্রীর প্রতি অনুগত, দলের প্রতি অনুগত নেতারা এবং সারা দেশের সাধারণ কর্মীরা এসব উদ্যোগের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেন। এ অবস্থায় গৃহে অন্তরীণ দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এক বিবৃতিতে বলেন, ‘চেয়ারপার্সন হিসেবে আমি দলের নেতা-কর্মী দেশ ও সমাজের সর্বস্তরের জনগণের পক্ষ থেকে দেয়া সব ধরনের সংস্কার প্রস্তাবকে স্বাগত জানাই। তবে এজন্য দলের গঠনতন্ত্র সংশোধন করার প্রস্তাব দলের কাউন্সিলরদের উপস্থিতিতে উপস্থাপন করতে হবে এবং গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কাউন্সিলেই চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন কাউন্সিলররা। ২০০৭ সালের ২৫ জুন বিএনপি মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া তার সংস্কার প্রস্তাব ঘোষণা করলে তাৎক্ষণিক বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এ বিবৃতি দেন। দলের একজন যুগ্ম মহাসচিব সাংবাদিকদের এটি পড়ে শোনান। তবে বিবৃতিটি মান্নান ভূঁইয়া ঘোষিত সংস্কার প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়া নয় বলে তিনি জানান।

 

এরপর বেগম খালেদা জিয়ার ওপর নজরদারি ও অন্তরিণ অবস্থা আরও জোরদার করা হয়। পরে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংগৃহীত মোবাইল ফোনে দেশের ভেতরে দলীয় এমপি ও তৃণমূল নেতৃবৃন্দ এবং দেশের বাইরে বিএনপি নেতাদের সাথেও টেলিফোনে যোগাযোগ এবং কনফারেন্সের মাধ্যমে বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতে অবিচল থাকার এবং সব ষড়যন্ত্র  মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়ার ডাক দেন বেগম খালেদা জিয়া।

 

বেগম খালেদা জিয়া ৫ জুলাই বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রমহমানের মাজার জিয়ারত করেন। প্রতি বৃহস্পতিবার তিনি রোজা রাখেন এবং রোজা উপলক্ষে স্বামীর কবর জিয়ারতে যান। সেখানে ফাতেহা পাঠ, দোয়া মোনাজাতসহ প্রায় ১ ঘন্টা তিনি অবস্থান করেন। এসময়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির নিয়ে যে কোন ধরনের ষড়যন্ত্র দলের নেতাকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীদের সজাগ ও সতর্ক থাকার এবং ঐক্যবদ্ধ থেকে যে কোন ধরনের ষড়যন্ত্র মোকাবিলার আহ্বান জানান। একইসঙ্গে সংস্কার করার জন্য কাউন্সিল আয়োজনের সুযোগ দিতে রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানান।

 

দেশীয় মিডিয়ায় কথা বলার সুযোগ না পেয়ে বেগম খালেদা জিয়া সারাদেশে বিভিন্ন এলাকা এবং বহির্বিশ্বে বিএনপি নেতাদের সাথে টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে নির্দেশনা দেন। ৭, ১৩, ১৮ ও ৩০ জুলাই এবং ৯ ও ১০ আগস্ট তিনি টেলিকনফারেন্সে নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলেন।

 

বেগম খালেদা জিয়ার অনমনীয় অবস্থা দেখে সেনা সমর্থিত সরকারও বিএনপির বিরুদ্ধে তাদের মরণ কামড় দেয়ার প্রস্তুতি নেয়। ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে বেগম খালেদা জিয়া ও তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে ক্যান্টনমেন্টের শহীদ মইনুল রোডের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। ২ সেপ্টেম্বর রাতেই তাদের নামে পোর্ট হ্যান্ডীলং-এ মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়। বেগম খালেদা জিয়া গ্রেফতার হওয়ার আগ মুহূর্তে সংগঠন বিরোধী কার্যকলাপে জড়িত থাকায় তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া এবং যুগ্ম মাহাসচিব আশরাফ হোসেনকে দল থেকে বহিস্কার করেন। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে দলের নতুন মহাসচিব নিয়োগ দেন।

 

গ্রেফতারের পর আদালতে দাঁড়িয়ে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সহধর্মীনি তিন বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, ‘বাংলাদশেকে নিয়ে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে।  এ ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই বিএনপি ভাঙার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে এবং আমাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। ইতোপূর্বে আমাকে দেশ থেকে বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করা হয়। এখন আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমি বাইরে চলে গেলে আজ আমাকে গ্রেফতার হতে হতো না। আমি বলতে চাই, এই দেশের মাটি ছাড়া আমি এবং আমার পরিবারের কোন ঠিকানা নেই। এই দেশ আমার ঠিকানা, এই দেশেই আমি মরব।’

 

তিনি ৮টা ২৫ মিনিটে বক্তৃতা দিতে দাঁড়ান। কোর্টে ১২ মিনিটব্যাপী মর্মস্পর্শী ও ঐতিহাসিক বক্তৃতা দেন তিনি। এসময় কোর্টে ছিল পিনপতন নীরবতা। এই বক্তৃতাটিই মূলত: বিএনপি ভাঙার ষড়যন্ত্রকে রুখে দেয়। এই বক্তব্য পরের দিন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ছাপা হলে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে সাহস সঞ্চার হয়। ঐক্যবদ্ধভাবে ষঢ়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে শুরু করে নেতা-কর্মীরা।

 

এদিকে অপর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে জুলাই মাসে গ্রেফতার করা হলেও আওয়ামী লীগ ভাঙ্গার জন্য সরকারকে সে রকম কিছু করতে দেখা  যায়নি। কিন্তু বিএনপিকে নিয়ে তাদের  ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। বরং একের পর এক অপকৌশল গ্রহণ করা হয়। দলীয় চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের পর বহিস্কৃত মহাসচিব মান্নান ভূঁইয়াকে দিয়ে ২৯ অক্টোবর রাতে দলের অসুস্থ নেতা সাইফুর রহমানের বাড়িতে ডিজিএফআই বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সাজানো বৈঠকের আয়োজন করে। ওই বৈঠকে কারারুদ্ধ স্থায়ী কমিটি সদস্যবৃন্দ এবং কারাগারের বাইরে একমাত্র খোন্দকার দেলোয়ার ছাড়া অন্য সবাইকে হাজির করিয়ে সাজানো বৈঠকে মান্নান ভূঁইয়ার বহিস্কারের এবং মহাসচিব খোন্দাকার দেলোয়ারের নিয়োগের সিদ্ধান্ত অননুমোদন করা হয়। সাইফুর রহমানকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন এবং মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিনকে অস্থায়ী মহাসচিব নিয়োগ দেয়া হয়। এর মাধ্যমে দলের ভাঙ্গন প্রক্রিয়াকে আরও একধাপ এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালায় সেনা সমর্থিত সরকার। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়।

 

সরকারের এই ষড়যন্ত্রের সাথে যোগ দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ড. এটিএম শামসুল হুদা। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ঘোষিত মহাসচিবের বিরুদ্ধে গঠনতন্ত্রের বাইরে ডিজিএফ’র চাপে গঠিত কমিটি ও তার অস্থায়ী মহাসচিবকে বিএনপি মহাসচিব হিসেবে গণ্য করে নির্বাচন কমিশন। বিএনপি  মহাসচিব হিসাবে মেজর হাফিজকেই আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন কমিশনের সাথে আলোচনার আমন্ত্রন জানান। মেজর হাফিজকে নিয়ে নির্বাচন কমিশন বৈঠক করে। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আদালতে দেয়া হলফনামায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির ৪ জন সিনিয়র নেতা ডিজিএফআই’র চায়ের দাওয়াতে তারা কিভাবে সাইফুর রহমানের বাড়িতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির তথাকথিত বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন তার বর্ণনা দেন। তারা স্বেচ্ছায় সেখানে যাননি এবং সিদ্ধান্তে স্বাক্ষর করেননি বলে এফিডেভিট করে ঘোষণা দেন। এম সাইফুর রহমানের ছেলেকে আগেই গ্রেফতার করে যৌথ বাহিনী। পরে তার অন্য ছেলে ও ছেলের স্ত্রীকে গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে অসুস্থ অবস্থায় তার ওপর ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করতে থাকে যৌথ বাহিনী।

 

এ পরিস্থিতিতে ২০০৭ সালের ৫ নভেম্বর বেগম খালেদা জিয়া কারাগার থেকে নির্বাচন কমিশনকে একটি চিঠি লিখেন। ওই চিঠিতে বিএনপি মহাসচিব হিসেবে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ও উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হান্নান শাহ’র সাথে সকল যোগাযোগ করার জন্য বলেন। কিন্তু ২০০৮ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন এ চিঠি বাস্তাবায়নে কোন উদ্যোগ নেয়নি। ওই চিঠিতে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, খোন্দকার দেলোয়ারই বিএনপির বৈধ মহাসচিব। বিএনপি সকল কাজের জন্য এখন থেকে তার সাথেই যোগাযোগ করতে হবে। অন্য কারো সাথে নয়।

 

এসময় বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে থেকেই আইনজীবীদের মাধ্যমে নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা দিতে থাকেন। নির্বাচন কমিশনের চালাকি বন্ধ করার দাবি জানিয়ে তিনি একাধিক চিঠিও লিখেছেন। ২০০৮ সালের ১৮ জানুয়ারি মায়ের মৃত্যুতে শোকাতুর খালেদা জিয়াকে দু’ঘন্টার জন্য প্যারোলে মুক্তি দেয়া হলে মায়ের লাশের পাশে বসেই তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘মায়ের মৃত্যুতে কি কেউ ভাল থাকার কথা বলতে পারে? এরপর দেশে মানুষ ভাল নেই। ৪০ টাকায় এক কেজি চাল কিনতে হলে সে দেশের মানুষ কিভাবে ভাল থাকবে। আমিও ভাল নেই’।

 

২০০৮ সালের ৫ মার্চ নাইকো মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে এসে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, নাইকো নিয়ে কোন অন্যায় ও দুর্নীতি করিনি। সবকিছু আইনের মধ্যেই করা হয়েছে। অহেতুক মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে বলে তিনি আদালতকে জানান।

 

আপসহীন খালেদা জিয়া সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, মিথ্যা মামলায় কারান্তরীণ থেকে তিনি ভোটার হবেন না। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকা ভোটারদের জন্য নিবন্ধনের শেষ দিন ৮ মার্চ পর্যন্ত তিনি ভোটার হননি। (৯ মার্চ ২০০৮, দৈনিক আমার দেশ)

 

২০০৮ সালের ২৩ জুন গ্যাটকো মামালায় জাতীয় সংসদ ভবনের বিশেষ আদালতে হাজিরা দিতে নেয়া হলে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘বর্তমান সরকারের লোকেরাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় দুর্নীতিবাজ। তিন মাসের ক্ষমতায় এসে সাংবিধানিক দায়িত্ব হিসেবে জাতীয় নির্বাচন করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। দুর্নীতি করে দেশটাকে অর্থনৈকিভাবে পঙ্গু করে দিয়েছে। দুর্নীতি ও ব্যর্থতার অভিযোগ মাথায় নিয়ে দ্রুত জাতীয় নির্বাচন দিয়ে তাদের ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়া উচিত।’

 

৯ জুলাই একই মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে এসে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, চোখের সামনে দেশটাকে ধ্বংস হতে দেয়া যায় না। ঐক্যবদ্ধভাবে দেশটাকে রক্ষার উদ্যোগ নেয়ার জন্য তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। (২০ জুলাই ২০০৮, দৈনিক আমার দেশ)

 

১৩ আগস্ট কারান্তরীন বেগম খালেদা জিয়ার সাথে আইনজীবীরা সাক্ষাত করতে গেলে বেগম খালেদা জিয়া তাদের স্পষ্ট নির্দেশনা দেন যে, মুক্তির জন্য অবৈধ সরকারের কাছে কোন আবেদন করবেন না তিনি। এজন্য দৃঢ় থেকে আইনী লড়াই করার নির্দেশ দেন আইনজীবীদের। 

 

দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও তার দুই ছেলের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেয়ার পাশাপাশি রিমান্ডে নিয়ে দু’ছেলের ওপর নির্যাতন চলে। কারারুদ্ধ অন্য নেতাদেরও রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়।  সারা দশে বিএনপি  নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতনের স্টীম রোলার চালায় সেনা সমর্থিত সরকার। সে তুলনায় আওয়ামী লীগের নামমাত্র কিছু নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। বিভিন্ন এলাকায় তাদের নেতা-কর্মীরা ছিলেন নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত।

 

এতো অমানুষিক নির্যাতনের পরও বেগম খালেদা জিয়া এবারও এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের আপসহীনতার মত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানে থাকেন। আর এতে স্থায়ীভাবে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ওয়ান ইলেভেনের সরকার নিজেদের সেফ রিটার্নের পথ খোঁজে। ওয়ান ইলেভেনের সরকারকে শপথ গ্রহণের সময়েই বঙ্গভবনে হাজির হয়ে অভিনন্দিত করেছিলেন শেখ হাসিনা। তাই সেফ রিটার্নের বিষয় আগেই খুব সহজেই তারা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সাথে সমঝোতায় পৌঁছায়। কারারুদ্ধ শেখ হাসিনা সরকারের সাথে সমঝোতা করেই ২০০৮ সালের জুলাই মাসে সব মামলায় জামিন ছাড়াই সরকারের বিশেষ অনুমতি নিয়ে পাড়ি জমান দেশের বাইরে। অন্যদিকে রিমান্ডে নির্যাতনে গুরুতর অসুস্থ বিএনপি চেয়ারপার্সনের দুই ছেলেকে সব মামলায় জামিন পাওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর বিদেশ যেতে হয়। তাদের বিদেশ না যাওয়া পর্যন্ত দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকেও কারারুদ্ধ করে রাখা হয়।

 

১১ সেপ্টেম্বর বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়া হলেও দলের অন্য নেতাদের মুক্তি না দেয়া, জরুরি আইন বহাল রেখে নির্বাচন আয়োজনসহ নানাভাবে বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার চেষ্টা চলে। একচোখা নির্বাচন কমিশন আগেই বিএনপি ভাঙার ষড়যন্ত্রে প্রকাশ্যে অংশ নিয়ে নিজেদের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সেনা প্রশাসন নিজেদের সমঝোতার অংশ হিসেবে শেখ হাসিনা ও তার নেতৃত্বাধীন মহাজোটের হয়ে নির্লজ্জ ও অনৈতিকভাবে কাজ করে। যা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল স্পষ্ট করেই লন্ডনে গিয়ে দেয়া তার সাক্ষাতকারে উল্লেখ করেন। আব্দুল জলিল বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও ডিজিএফআইয়ের সাথে সমঝোতা করেই আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। কিভাবে  কার সাথে সমঝোতা হয়েছিল, তার কিছু উদাহরণও তিনি তুলে ধরেন। এ জন্য আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা তার ওপর হামলাও করে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ থেকে তাকে বাদ দেয়া হয়। সুদূর প্রসারি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে গোপন সমঝোতার নির্বাচনে বিএনপিকে হারিয়ে দেয়া হয়।

 

ওয়ান ইলেভেনের সরকার দুর্নীতি দমনের নামে রাজনীতি দমনের যে প্রক্রিয়া শুরু করে, তাতে করে দেশ অন্তত ২০ বছর পিছিয়ে গেছে বলে পর্যবেক্ষকরা ইতোমধ্যেই মন্তব্য করেছেন। তারা সংবিধান বহির্ভূতভাবে ক্ষমতায় এসে দু’বছর দেশ শাসন করেছে। শুরুতেই তারা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নামে গ্রামীণ হাটবাজার ও অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে সারা দেশের বাজারকে অস্থির করে তোলে। তাদের সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দামে ৩৫/৪০ টাকা কেজি দরে মোটা চাল বিক্রি হয়। তেল, ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম ছিল আকাশ ছোয়া। রাষ্ট্রের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় তারা চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। জনমানুষের সাথে সম্পর্কহীন ১১ জন উপদেষ্টা এবং তাদের পরিচালনাকারী গুটি কয়েক জেনারেলের কাছে দু’বছর দেশের মানুষ জিম্মি হয়েছিল। দেশের উন্নয়ন, বিনিয়োগ, প্রশাসন সর্বত্র এক ভয়াবহ স্তবির অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ এক দুঃসহ কাল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে ভয়াবহ ষড়যন্ত্র হয়। আর এমন এক সাজানো নির্বাচনে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গোপন আঁতাতের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে।

 

২০০৯ সাল

 

 ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিজেদের বাঁচাতে আঁতাতের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়ার বিষয়টি দেশবাসীর কাছে ষ্পষ্ট হলেও গণতন্ত্রের স্বার্থে বিএনপি নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয়। এমনকি গণতন্ত্রকে অর্থবহ করতে বিরোধী দল হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সংসদ সদস্যরা নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে যোগ দেন। ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়ে বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সরকারকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন,“গণতন্ত্রের স্বার্থে আঁতাতের নির্বাচন মেনে নিয়েছি। অনির্বাচিত স্বৈরতান্ত্রিক সেনা সমর্থিত সরকারের চেয়ে রাজনৈতিক সরকার অপেক্ষাকৃত ভাল হবে মনে করেই আমরা সংসদে যোগ দিয়েছি। এখন গত দু’বছরে  সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গণতন্ত্র বিরোধী ও নেতিবাচক কর্মকান্ডের বিচার করতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। একজন্য আমরা সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই”।

 

এদিকে ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর দরবার হলে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ঘটে। এসময়ে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি অহেতুক সমালোচনা ও আন্দোলনের পথে না গিয়ে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে অটল থেকে সরকারকে গঠনমূলক পরামর্শ দিয়ে গেছে। এসময়ে বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সরকারকে পরামর্শ দিয়ে ২৬ ও ২৭ ফেব্রুয়ারি দুটি বিবৃতি দেন। এরপর ৪ এপ্রিল জাতীয় সংসদের অধিবেশনে যোগ দিয়ে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারকে পরামর্শ দিলেও সরকার দলীয় সংসদ সদস্যরা নেতিবাচক রাজনীতির সূচনা করেন। সংসদে অযৌক্তিক ও বিদ্বেষপূর্ণ বক্তৃতা প্রদান করেন তারা। ৭ এপ্রিল নবম জাতীয় সংসদের সমাপনী অধিবেশেনে বেগম খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অগণতান্তিক কর্মকান্ডের বিচার করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

 

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১০তম জন্মোৎসব উপলক্ষে ২৫ মে মহানগর নাট্যমঞ্চে জাতীয়তাবাদী সমাজিক সাংস্কৃতিক সংসদ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বক্তৃতা দেন এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে ঐক্যবদ্ধ প্রস্তুতি ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

 

টিপাইমুখে বাঁধ দিতে যখন ভারত সরকার উদ্যত এবং বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে কোন প্রকার বিরোধিতা করা হচ্ছে না, তখন বিরোধী দল বিএনপি ১৮ জুলাই হোটেল শেরাটনের উইন্টার গার্ডেনে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ‘টিপাইমুখে বাঁধ বাংলাদেশের জন্য ক্ষতির কারণ হবে’ মর্মে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে।

 

১ সেপ্টেম্বর বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন করা হয়। ৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া তাঁর ভাষনে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখতে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। 

 

নভেম্বরের প্রথম দিকে গাজীপুরে গার্মেন্টে  বিক্ষোভ ও ভাংচুরের ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে যখন বিরোধী দলের আন্দোলনের ভয়ে নানামুখী দোষাদুষীর বক্তৃতা দেয়া হচ্ছিল, তখন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ৬ নভেম্বর বাটেক্সপো-২০০৯-এর সমাপনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে এসব সমস্যা সমাধানে উদ্যাগী হতে সরকারকে গঠনমূলক পরামর্শ দেন। আধিপত্যবাদীদের ষড়যন্ত্রে গার্মেন্ট খাতে নৈরাজ্য সৃষ্টি হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

 

২৮ নভেম্বর পবিত্র ঈদুল আযহার দিনে বিএনপি চেয়ারপারসন সরকারকে নাগরিক দুর্ভোগ কমাতে উদ্যাগ নেয়ার পরামর্শ দেন এবং দেশের স্বার্থ বিরোধী যে কোন চুক্তি না করার জন্য আহ্বান জানান। অন্যথায় জনগণকে সাথে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলেও তিনি সরকারকে সাবধান করে দেন।

 

সরকারকে এভাবে সহায়তা করে গেলেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার বিরোধী দলকে হয়রানি ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক মামলা প্রত্যাহারে সরকারের একচোখা নীতি অর্থাৎ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মামলা প্রত্যাহার না করে শুধু সরকার সমার্থিতদের মামলা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এ নিয়ে সাধারণ জনগণের মাঝেই সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এরপরও নতুন নতুন মামলা দায়ের করে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পরিবারকে হয়রানি করা হচ্ছে। বেগম খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদের জন্য সরকার নীল নকশা এঁকেছে। এ বিষয়টি নিয়ে আদালতে আইনি লড়াই চলছে।

 

বিএনিপর পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিল ও তৃনমূলের কাউন্সিল অনুষ্ঠান নিয়ে আওয়ামী সরকারের নেতিবাচক চেহারা  দেখা গেছে। বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের হামলা এবং একই স্থানে কর্মসূচি দিয়ে সরকারিভাবে ১৪৪ ধারা জারি করানোর ঘটনা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

 

এসবের মাঝেও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। পঞ্চম কাউন্সিল অনুষ্ঠানসহ দলের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করতে বেগম খালেদা জিয়া মুক্ত হাতে পদক্ষেপ নিচ্ছেন।

 

তৃতীয় বিশে^র রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংকট সুবিদিত। উপনিবেশক শাসন এই সংকটের অন্যতম কারণ। উপনিবেশিক উত্তরাধিকার ‘আমাদের কথা আমাদের মত করে বলতে শেখায় না, বরং আমাদের কথা তাদের মত করে ভাবতে শেখায়।’ প্রাচ্য রাষ্ট্রদর্শনের আধুনিক দিকপাল এডওয়ার্ড সাঈদ এর মন্তব্যের প্রতিফলন বাংলাদেশে রাষ্ট্র ও সামাজে সর্বত্র। বাংলাদেশ বৃটেন থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে সংসদীয় গণতন্ত্র পেয়েছে। কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে সংসদীয় রাজনীতির সক্ষম নেতৃত্ব পায়নি এবং নিজে সৃষ্টিও করতে পারেনি।

 

লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশ উদ্দিষ্ট গণতন্ত্রের পথেই যাত্রা শুরু করে। কিন্তু রক্ষকই ভক্ষক হয়ে যায়। যারা গণতন্ত্রের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন, তারাই তিন বছরের মাথায় অনুসৃত গণতন্ত্রের কবর  রচনা করেন। একদলীয় স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সম্মতির মাধ্যমে শাসক  নির্ধারনের চিরায়ত গণতান্ত্রিক পদ্ধতি পরিত্যক্ত হয়। বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা অস্বীকৃত হয়। ‘একনেতা একদেশ’ শ্লোগানে হিটলার মুসোলিনীর প্রেতাত্মা প্রতিধ্বনিত হয়। মধ্য আগস্টের পট পরিবর্তনের পর ঘটনা প্রবাহ জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতার পাদপ্রদীপে নিয়ে আসে। গোটা জাতির সামনে যখন একটি ক্রান্তিকাল-স্বাধীনতার সংকট, স্থিতিশীলতার সংকট এবং সংহতির সংকট, গোটা জাতি যখন গণতন্ত্রের চেয়ে স্বাধীনতা-সংহতি জোরদারকরণে চেষ্টিত, মওলানা ভাসানীর মত বর্ষিয়ান নেতা যখন গণতন্ত্র তথা নির্বাচনের চেয়ে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে শঙ্কিত, তখন জাতির কর্ণধার জিয়াউর রহমান গণতন্ত্রায়নের পথে অগ্রসর হন। গণভোটের মাধ্যমে শাসনতন্ত্রের কাঙ্খিত পরিবর্তন আনয়ন করেন। ১৯৭৮ সালে বহুদলীয় ব্যবস্থার ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এবং ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। নির্বাচিত সংসদে পুন:প্রবর্তিত বিধি ব্যবস্থার অধীনে সাংবিধানিক পরিবর্তন এনে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। এই পরিবর্তনের মাধ্যমে চতুর্থ সংশোধনী, যার মাধ্যমে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছিল-তা পরিত্যক্ত হয়। আওয়ামী লীগসহ সকল রাজনৈতিক দল বৈধ কাযক্রম শুরু করে। ইতোপূর্বে ‘বাংলাদেশে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ অর্থাৎ’ ‘বাকশাল’ নাম ধারন করে আওয়ামী লীগ নিজেই নিজের যবনিকা পাত করেছিল।

 

জিয়াউর রহমান পরিপূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক প্রথা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর পুন:র্জীবন ঘটান। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা পুন:প্রতিষ্ঠিত হয়। এসবই করেন আপাত: গণতন্ত্র বিরোধী বলে অভিযুক্ত একজন সামরিক শাসক। কার্য পরম্পরায় যখন রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি প্রতিষ্ঠা অর্জন করে, তখন বৈরী বুদ্ধিজীবিরা একে ‘সেনা ছাউনির দল’ বলে বিশেষিত করে। অথচ যারা গণতন্ত্রের তাবেদার বলে দাবি করেন তারাই সামরিক শাসনকে স্বাগত জানান, স্বৈরাচারীকে বৈধতা দিয়ে নির্বাচন করেন এবং মহাজোট করে ক্ষমতায় আরোহন করেন। অথচ ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত নিপীড়ন-নির্যাতন এবং রক্তপাতকে অতিক্রম করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে বারবার জাতীয়তাবাদী শক্তিকে শাসনের সম্মতি দিয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।

 

তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো বাংলাদেশের চার দশকে দু’বার গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৭৫ এবং ১৯৮১ সালে। এ দু’সময়ই প্রথমত: জিয়াউর রহমান, দ্বিতীয়ত: তারই সহধর্মিনীর হাতে স্বৈরশাসকের পতন শেষে সংবিধানের প্রত্যাশিত সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিবারেই কর্তৃত্ববাদী এবং সবাত্বকবাদী শক্তির মোকাবেলা করতে হয় জাতীয়তাবাদী শক্তিকে। আপামর জনতার নীরব সমর্থন ধন্য জাতীয়তাবাদী শক্তিই গণতন্ত্রের সর্বশেষ অভিভাবক এবং বিশ্বস্ত রক্ষক। গণতন্ত্র এবং বিএনপি সমর্থক এবং পরস্পর পরিপূরক।

 

শহীদ জিয়াউর  রহমান সেই রাষ্ট্রনায়ক, যিনি শতধা বিভক্ত জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী সব স্তরের মানুষকে একত্র করেন। এই মানচিত্রের বিগত অর্ধশতাব্দীর ইতিহাসে এ রকম ইস্পাত কঠিন ঐক্য আর দেখা যায়নি। ১৯৭৭ সালের গণভোট, ১৯৭৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং ১৯৭৯ সালের সংসদীয় নির্বাচনে এ ঐক্যের প্রমাণ মেলে। ১৯৭১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদের মত মহুমাত্রিক সংসদ আর সৃষ্টি হয়নি। ঐ সংসদে সকল মত ও পথের দুর্লভ প্রতিনিধিত্বের  প্রতিফলন ঘটে। গণতন্ত্রের এতটাই নির্ভয় এবং নির্ভরযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টি হয় যে, কমিউনিষ্ট পার্টিসহ চরম বাম ধারার তোয়াহা এবং ডান ধারার মাওলান আব্দুর রহিমও নির্বাচিত হন। সুরঞ্জিত সেন গুপ্তর মত ঝানু পার্লামেন্টারিয়ানও স্বীকার করেন যে, জিয়া সংসদ সদস্যদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতেন। এবং সকল সীমাবদ্ধতার মাঝেও ঐ পার্লামেন্ট যথেষ্ট কার্যকর ছিল। বাংলাদেশের ছোট বড় দল রাজনৈতিক ব্যক্তি, ডান বাম, মধ্য ধারার প্রতিনিধিত্ব, প্রধান দু’টো দলের প্রধান্য-সব মিলিয়ে একটি চমৎকার বিরল জাতীয় ঐক্যমত্যের সৃষ্টি হয়। জিয়া সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেন। আইন-শৃঙ্খলার যথেষ্ট উন্নতি হয়। খাল খনন, খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণকরণ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং যুবসমাজকে উন্নয়ন কর্মকান্ডে সম্পৃক্তকরণের মতো বহুমুখী  কার্যক্রমে ফলে জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে গণজাগরণ সুচিত হয়। সমস্ত জাতি ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ উদ্বেলিত হয়। এ ব্যাপক কর্ম উদ্দীপনা জাতীয় শত্রুদের শঙ্কিত করে তোলে। দেশী এবং বিদেশী চক্রান্তে অবশেষে  জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয়।

 

জিয়ার অন্তর্ধাণের পর তাঁর সহধর্মিনী বাংলাদেশের নেতৃত্বে দিতে অগ্রসর হন। প্রাথমিক দ্বিধা দ্ব›দ্ধ, আগ্রহ-নিগ্রহ, সংকট, ষড়যন্ত্র অতিক্রম করে তিনি বেশ সফলতার সাথে বাংলাদেশ রাষ্ট্র তরনীকে উদ্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাবার চেষ্টা করেন।

 

বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য সামরিক শাসন একটি সমস্যা হয়ে যায়। বিশেষত: এই প্রাথমিক অবস্থায়।  গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠানিকতা অর্জনের আগে তো আরও বিপদজনক। ১৯৮১সালের প্রথম দিকে সে রকম একটি বিপদজনক অভিজ্ঞতা দেশ সঞ্চয় করে। সেনাবাহিনী প্রধান ক্ষমতা দখল করেন। সর্বজনগ্রাহ্য একটি জাতীয় নির্বাচন ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত একজন প্রধান প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এটি বাংলাদেশের জন্য দু’ধরনে সংকট সৃষ্টি করে: গণতন্ত্রের সংকট, নেতৃত্বের সংকট।

 

এটা একটি অভাবিত আশার কথা যে শহীদ জিয়ার সহধর্মিনী এ দু’টো বিষয়েই আমাদের পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৯ বছর তিনি গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করেছেন। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে আস্থার সৃষ্টি হয়েছে- তা তাকে (খালেদা জিয়াকে) অভিষিক্ত করেছে। ১৯৯০ সালের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন থেকে ২০০৯ পর্যন্ত তিনি তিন তিন বার জাতির কর্ণধার হয়েছেন। জাতি তাঁর প্রতি যে আস্থা অর্পণ করেছে যথার্থতার সাথেই তা তিনি সম্পন্ন করেছেন। বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী বিএনপিকে ধ্বংসের নীল নকশা বাস্তবায়নের করতে দেয়নি। তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কোটি মানুষের জন্য উজ্জ্বল আলোক বর্তিকা ধারন করেছেন। হতাশা ও হিংসায় নিমজ্জিত জাতিকে আশার আলো দেখিয়েছেন। অশিক্ষা কুশিক্ষা দারিদ্র্য পীড়িত এই জাতিকে উন্নয়ন আর অগ্রগতির পথে ধাবিত করেছেন। কখনও বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান, আবার কখনও ক্ষমতার মসনদে বসে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি-এর নেতৃত্বে যারা আসবেন, তারাও দল ও দেশের প্রয়োজনে ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর হবেন, এটিই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূল স্পৃহা।